মিজানুর রহমান খান
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৪২ এএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৫৪ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আ মরি বাংলা ভাষা

বাংলা ভাষার চর্চা, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠায় উদাসীনতা

বাংলা ভাষার চর্চা, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠায় উদাসীনতা

মানবসমাজে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সবচেয়ে শক্ত এবং মূল্যবান উপাদান হলো ভাষা। ভাষা বেঁচে থাকে মানুষের জবানিতে তথা মানুষের মস্তিষ্কে। জিহ্বায় উচ্চারিত না হলে ভাষার অস্তিত্ব থাকে না; ভাষা মরে যায়। বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা জগৎসভায় সমাদৃত। এজন্যই ভাষাসংগ্রাম এবং ভাষার জন্য যুদ্ধজয় বাঙালির রাজনৈতিক আদর্শকে মজবুত ভিত্তি দিয়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাজপথে বাঙালির স্লোগানটা ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। কিন্তু এ প্রসঙ্গটাই আমরা বারবার ভুলে যাই। ভুলে যাই বলে আমরা জীবনাচরণে ভুল করি, সমাজ গঠনে ভুল করি, মানববিদ্যাচর্চায় ভুল করি, বিজ্ঞানচর্চায় ভুল করি, এমনকি রাজনীতির দর্শনচর্চায়ও ভুল করি নিরঙ্কুশভাবে।

যে দেশের গোড়াপত্তন বাংলা ভাষা রক্ষার ঐতিহাসিক আন্দোলনের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত, সেই বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতার দায়ভার সমগ্র জাতির—এ কথা কবুল করে নিলে আলোচনা সহজ হয়। কারণ বাঙালির অন্তরের আবেগের পারদ এত দ্রুত ওঠানামা করে যে, আলোচনা শুরু হওয়ার আগেই বাঙালি তর্কে লিপ্ত হয়। তর্ক বা বিতর্ক ভালো জিনিস নিঃসন্দেহে। কিন্তু কূটতর্ক অর্থহীন ও অস্বাস্থ্যকর। সন্দর্ভ রচনা নয়, স্বল্প পরিসরে আমরা আলোচনার সূত্রপাত করব এভাবে যে, বাংলাদেশে বাংলা ভাষার চর্চা, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাঙালি জাতি সর্বৈব উদাসীন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বাঙালি এবং প্রায় সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাঙালি, বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশ—এত প্রাসঙ্গিক প্রভাবক থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা হওয়া না হওয়া বিষয়ে এখনো আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে হয় আমাদের। কিন্তু কেন? এর উত্তর অন্বেষণ সূত্রেই মূলত আজকের এ নিবন্ধ রচনার প্রয়াস। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে আমরা পালন করে আসছি প্রায় ৭০ বছর ধরে। পাকিস্তান আমলে একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল প্রেরণা, দেশপ্রেম এবং বাঙালি হিসেবে দায়িত্ববোধের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। এ সূত্রেই মূলত একুশে ফেব্রুয়ারি নয়া উপনিবেশ তথা পাকিস্তানি শাসক ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান আয়ুধ হয়ে ওঠে বাঙালির কাছে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে পরম পবিত্র এক বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ভাষা আন্দোলন এবং একুশে ফেব্রুয়ারি। মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে স্বাধীন রাষ্ট্রে একুশে ফেব্রুয়ারি সমান গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে বাঙালির গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান নির্মাণে আমরা যতটা আগ্রহী; বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মোটেও আমরা ততটা ছিলাম না; এখনো নই। আমাদের বাংলা একাডেমি আছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আছে; ইউনেসকো কর্তৃক বিশ্ব-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের ঘোষণা আছে এবং জাতিসংঘে প্রথম বাংলা ভাষায় ভাষণ দেওয়ার ইতিহাস আছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা বাংলায় পাঠদান করি, বাংলায় পত্রপত্রিকা প্রকাশ করি, পাঠ্যপুস্তক বাংলায় রচনা করি। এতদ্ব্যতীত প্রতিদিন আমরা উদয়াস্ত বাংলায় কথা বলি। তারপরও আমরা বলতে পারি, বাংলা ভাষার শতভাগ ব্যবহার আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। এতৎসংক্রান্ত ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আমাদের চারপাশে বর্তমান। বাংলা ভাষার এই করুণ দশার কয়েকটি কারণ মোটা দাগে চিহ্নিত করা যায়—(১) বাঙালির উপনিবেশিত মন, (২) বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণির উন্নাসিকতা, (৩) বিচারালয় ও সরকারি দপ্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত না করা, (৪) প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা ভাষাশিক্ষার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না করা এবং (৫) শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষাচর্চার অনাগ্রহ ও ঔদাসীন্য। প্রথমত, বাঙালি জাতি মনে করে যে, বাংলা ভাষা কুলীন বা অভিজাত ভাষা নয়।

বাঙালির আত্মানুসন্ধানহীনতা ও চিত্তদৈন্যের কারণেই এমন বোধ তার বোধিমূলে শিকড় গেড়েছে। প্রায় সহস্রাব্দব্যাপী শাসিত ও পরাধীন জাতির পরাধীন মন তার আত্মশক্তির সন্ধান পায়নি। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে শেখেনি কখনো। অথবা বলা যেতে পারে, বহিরাগত রাজশক্তি কৌশলে বাঙালির মনকে চিররুগ্‌ণ করে দিতে পেরেছে। তাই কখনো ফারসি ভাষায়, কখনো ইংরেজিতে, কখনোবা উর্দুতে বাঙালি তার স্বপ্নসৌধ নির্মাণ করতে চেয়েছে। বহিঃশক্তির আক্রমণ এবং শাসন-শোষণের পরও বাংলার সমাজে ভালো কিছু যে ঘটেনি, তা নয়। মুসলমানি শাসনামলে রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবতের অনুবাদ এবং ইংরেজ রাজশক্তির বাণিজ্যবুদ্ধির সূত্রে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা, ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা এবং বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা যুগান্তকারী ঘটনা নিঃসন্দেহে। কিন্তু জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে পরাধীন বাঙালি অগৌরবকে গৌরব জ্ঞান করেছে চিরকাল। সামান্য ইংরেজি শিখে লিপিকার, পেয়াদা, সেরেস্তাদার বা কেরানি হতে পারাকেই আশীর্বাদ জ্ঞান করেছে দুইশ বছরব্যাপী। ফলে বাঙালির শুষ্ক, রুগ্‌ণ, নির্জীব ও পরাজিত মন আজও সঞ্জীবিত হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে বাংলা ভাষার প্রশ্নে শিক্ষিত বাঙালির হীনম্মন্যতা আজও তার মগজে বাসা বেঁধে আছে।

দ্বিতীয়ত, তিনশ বছরের কলকাতা এবং দুইশ বছরের প্রাচীন ঢাকা শহরে একশ্রেণির মানুষ আবাস গড়ে তুলে বসবাস শুরু করে শহুরে সুবিধাপ্রাপ্তির আশায়। কলকাতায় শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি আর ঢাকায় শিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ইতিহাসের সত্য। কিন্তু কলকাতায় বাবু সংস্কৃতি আর ঢাকায় সাহেব সংস্কৃতির ধারক-বাহকদের কাছে বাংলা ভাষা সমাদৃত হয়নি কোনোকালে। উভয় সম্প্রদায় জীবনের আর্থিক নিরাপত্তার খাতিরে তথাকথিত উন্নত জীবনযাপনের জন্য মূলত ইংরেজি ভাষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। যদিও হিন্দু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির তুলনায় মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি পিছিয়ে পড়েছিল পুরো একশ বছর। সাময়িক পত্রিকা ‘দিগ্দর্শন’ এবং ‘সওগাত’-এর প্রথম প্রকাশকালের ব্যবধানই সে বার্তা জানিয়ে দেয়। এক সম্প্রদায়ের কাছে বেদ-পুরাণ-ভাগবত এবং অন্য সম্প্রদায়ের কাছে কোরআন-হাদিস-ফতোয়া ছিল আরাধ্য বিষয়। বস্তুত চাকরিপ্রার্থী কট্টর হিন্দু ও মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি—এ উভয় সম্প্রদায়ের কাছে বাংলা ভাষার কোনো মর্যাদা বা মূল্য ছিল না। বাংলা ভাষায় ইহলৌকিক বা পারলৌকিক কোনো প্রাপ্তিযোগ হবে না বিধায় তৎকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে বাংলা ভাষা উপেক্ষিতই থেকেছে যুগের পর যুগ। আজও তার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রয়েছে কলকাতা ও ঢাকার সমাজে। এ দুই শহরে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যমে ও ইংরেজি ভার্সনের অসাধারণ সব স্কুলের বিস্তার ঘটেছে, যেখানে শুধু বিত্তশালীদের সন্তানরা লেখাপড়া করে। এসব স্কুলের নামকরণও করা হয় বিদেশি ভাষায়, বিশেষত ইংরেজি ভাষায়। নগর সমাজের এ বিত্তশালীরাই মূলত হঠাৎ বাবু বা হঠাৎ সাহেব। বাংলা ভাষার শুশ্রূষা বা উন্নতি সাধনে এদের কোনোই ভূমিকা নেই। ব্যতিক্রম শুধু সাহিত্যিক-সাংবাদিক-সংস্কৃতিকর্মী-লেখক ও শিক্ষক। বাংলা ভাষার জন্য যদি কিছু করে থাকেন তো সাহিত্যিক-সাংবাদিক-সংস্কৃতিকর্মী, লেখক-শিক্ষকরাই করেছেন।

তৃতীয়ত, ভূরাজনৈতিক কারণে বাঙালির সহজ মনে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপিত হওয়ায় ক্রমেই বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ও রসাস্বাদন থেকে দূরে সরে গেছে বাঙালি। শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত হিন্দু মনে করে যে, বেদ-উপনিষদ-পুরাণ-ভাগবতের ভাষাই বাংলা ভাষা এবং ওসব শাস্ত্র থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত মুসলমান মনে করে যে, বিপুল পরিমাণ আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় বিদ্যমান, তাই বাংলা ভাষাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের থাবা থেকে রক্ষা করে স্বতন্ত্র এক বাংলা ভাষা সৃষ্টি করা তমদ্দুনের কাজ। সুতরাং হিন্দু ও মুসলমানের বাংলা ভাষা সংক্রান্ত ইতিহাসজ্ঞানের অভাব এবং সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কারণে বাংলা ভাষার হয়েছে মরণদশা। উভয় সম্প্রদায়ের কাছে বাংলা ভাষা এক উপেক্ষার বস্তু হিসেবেই রয়ে গেছে বহু শতাব্দী।

চতুর্থত, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও কোনো স্তরেই মান বাংলা ভাষাশিক্ষার ব্যবস্থা নেই। বর্ণমালা, আদর্শলিপি বা ব্যাকরণের সূত্র কখনোই ভাষা নয়। ভাষা মূলত মুখে ব্যবহার করার জিনিস বা বিষয়। ব্যাকরণ মুখস্থ করে বা করিয়ে অন্তত ভাষা শেখা বা শেখানো যায় না। ভাষার ধ্বনি চেনার প্রতীক বা চিহ্ন হলো বর্ণ। বর্ণের পর বর্ণ জুড়ে দিয়ে শব্দের সৃষ্টি হয়। শব্দ আবার পদমর্যাদা পায় তখন, যখন তা বাক্যে ব্যবহৃত হয়। পুরো প্রক্রিয়াটির প্রথমেই আসে ধ্বনি। বাংলা ভাষার ধ্বনি উচ্চারণে বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের কথা বাদ থাক, যদি শিক্ষিতজনের বাংলা ভাষার ধ্বনি উচ্চারণের অবস্থা লক্ষ করি, সেখানে পাওয়া যাবে বিপুল শৈথিল্য, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা। ইংরেজি Night, Might, Sight বানানে কেন gh ব্যবহৃত হয় সে ব্যাপারে আমরা প্রশ্ন উত্থাপন করি না। Future, Capture, Picture শব্দের উচ্চারণ কেন ফিউচার, ক্যাপচার, পিকচার হয়, তার জন্য আমাদের মাথাব্যথা নেই। যত মাথাব্যথা আমাদের বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে। বাংলা ভাষা কঠিন ভাষা, বাংলা একটি জটিল ভাষা—এ জাতীয় কথা বলে ছল করে, আত্মপ্রতারণায় লিপ্ত হয়ে বাঙালি তাদের একেকটা জীবন পার করে দিচ্ছে। বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে বড় বড় ডিগ্রিধারী পণ্ডিতকেও বলতে শোনা যায়—‘আমি তো ভাই বাংলায় পড়িনি।’ যেন সে ইংল্যান্ডে জন্মেছে এবং ইংরেজি তার মাতৃভাষা। পিতামাতাও হয় ব্রিটিশ, না হয় আমেরিকান। এ ধরনের পণ্ডিত জানে না যে, বাংলা ভাষায় পূর্ণ জ্ঞান না থাকা সম্পূর্ণ লজ্জার বিষয় এবং তার অধীত বিদ্যা ও জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই জাতির কাছে। সুতরাং নিন্দা হজম করা ছাড়া বাংলা ভাষার ভাগ্যে ভালো কিছু জোটেনি। পঞ্চমত, বাংলাদেশের জনজীবনে সরকারি দপ্তর, বিচারালয়, আধাসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয় চেতনাকে ধারণ করে চলবে বলেই মানুষ মনে করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে তা ঘটেনি। বিশেষত সরকারি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় বাংলা ভাষার পূর্ণ প্রচলন ও প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে বহু বছর। ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ সংশোধন করে ২২ জানুয়ারি ২০১৫ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটে এ আইনের সংক্ষিপ্ত শিরোনাম করা হয়েছে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন (সংশোধন) আইন, ২০১৫’। এ আইনে বর্ণিত ধারা বা উপধারাগুলো লক্ষযোগ্য—

৩(১) ‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সবক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।’

(২) ৩ (১) ‘উপধারায় উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’

(৩) ‘যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহা হইলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’

মহান সংসদে পাস করা বিল যখন আইনে পরিণত হয়েছে, তখনো কি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো এ আইন যথাযথভাবে মান্য করে চলছে? যদি তা মান্য করা না হয় তার জন্য সরকার আজ অবধি কি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে? অথবা এ আইন মান্য করার জন্য সরকার কি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে? এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে দেশের নাগরিক সম্প্রদায় কিছু জানেন কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায়।

ষষ্ঠত, বাংলা ভাষার উর্বর এক মহাভূমিতে বসবাস করেও বাঙালি বাংলা ভাষার মর্ম উপলব্ধি করতে পারে না। পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে সুনির্দিষ্ট এক ভাষিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠে শিশু। অন্য ভাষার প্রভাব এবং চাপ না থাকলে মা-বাবার ভাষাই সে আয়ত্ত করতে থাকে অনুকূল পরিবেশে। বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী বা বাংলাভাষী জনজীবনেও একই ঘটনা ঘটে স্বাভাবিকভাবে। বাংলাভাষীরা কায়ক্লেশহীনভাবে বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে শৈশব থেকে। মা-বাবার ব্যবহৃত ভাষাই আত্মীকৃত হয় শিশুর মনোজগতে, মস্তিষ্কে। এ ভাষা হতে পারে কোনো অঞ্চলের উপভাষা, হতে পারে শহুরে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিতের আধাখ্যাঁচড়া ভাষা অথবা হতে পারে তা মান বাংলা ভাষা। মান বাংলা ভাষা আয়ত্ত করাই যদি বাংলা ভাষাশিক্ষার শেষ লক্ষ্য হয় তাহলে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মান বাংলা ভাষাশিক্ষার ব্যবস্থা আজও বাংলাদেশে করা হয়নি। উপভাষা ব্যবহার করেও যেহেতু প্রতিদিনের কাজ চলে, পরীক্ষায় ভালো ফল করা যায় এবং বেঁচে থাকার জন্য মোটামুটি একটা বৃত্তি জোটে; তখন আগ্রহী হয়ে সময় নষ্ট করে কায়ক্লেশ সহ্য করে মান বাংলা ভাষাশিক্ষায় তারা আগ্রহী হয়ে উঠবে না; এটাই স্বাভাবিক। মূলত তারা মান বাংলা ভাষাশিক্ষার প্রয়োজন বোধ করে না।

সপ্তমত, বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে বাংলা ভাষার শরীরে ঢোকানো হচ্ছে ভাষাবিকৃতি নামক এক রোগের জীবাণু। গণমাধ্যমের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা বিশেষত অনুষ্ঠানের সঞ্চালকরা বাংলা ভাষা ব্যবহারের নামে করে চলেছে খিস্তি। তারা যে বাংলা বাক্যগুলো ব্যবহার করছে, সেসব বাক্যের প্রত্যেকটিতে থাকছে একাধিক অশ্রাব্য ইংরেজি শব্দ। উপায়হীন দর্শকশ্রোতা সেসব গিলে গিলে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে বাংলিশ বা বাংরেজি মার্কা কিম্ভূতকিমাকার ভাষায়। এতে ক্ষতি হচ্ছে নতুন প্রজন্মের; ক্ষতি হচ্ছে বাংলা ভাষার। অথচ সরকারের তথ্যবিষয়ক মন্ত্রণালয় এসব দেখছে না। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না বা এসব বন্ধ করছে না।

প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আসে একুশে ফেব্রুয়ারি যায়; বাংলা ভাষার উন্নতি হয় না। সমগ্র জাতি একুশের ভোরে নগ্ন পায়ে ফুলের ডালা হাতে শহীদ মিনারের বেদিতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়, কিন্তু বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করে না। আলোচনার মঞ্চে জ্বালাময়ী বক্তৃতায় বাংলা ভাষার জন্য পারলে নতুন করে জীবন উৎসর্গ করে। কিন্তু সারা বছর তারা হাইব্রিড বাংলায় খিস্তি করে। পরিপূর্ণ শুদ্ধ বাংলায় লিখতে তো পারেই না; বলতেও পারে না তারা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, বিচারালয়, সড়ক-জনপথ, বিপণিবিতান সর্বত্র ইংরেজি ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার। স্কুলের নাম, বাড়ির নাম, গাড়ির নাম, সন্তানের নাম, পোষা প্রাণীর নাম, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হচ্ছে ইংরেজিতে। আমন্ত্রণপত্র, প্রচারপত্র, ব্যানার, এমনকি ফেস্টুনে অকারণ ও অপ্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে ইংরেজি ভাষা। এসব দেখে বোঝা যায়, বাঙালি কতটা ‘পরধনলোভে মত্ত’ জাতি। প্রকৃতপক্ষে বাঙালি আত্মবিনাশী বা আত্মধ্বংসী এক জাতি হিসেবে পরিচিত।

লেখক: অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মেসিদের দুঃস্বপ্ন কানাডায়, ফাইনালে উঠতে মায়ামির চাই ৪ গোল!

থাইল্যান্ডে বিমান বিধ্বস্ত, ৬ পুলিশ সদস্য নিহত

পাকিস্তানের পদক্ষেপে আকাশে বিপদে ভারত

পানির জন্য পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করবে?

বায়োমেট্রিকে ব্যর্থ হলে শাস্তির আওতায় আসবে মালদ্বীপ প্রবাসীরা

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে মোদির প্রতি আহ্বান ওয়াইসির

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে চাকরির সুযোগ

কাশ্মীর হামলা ইস্যুতে পাকিস্তান কী করল

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বড় ৭ পদক্ষেপ

হাসপাতালের টয়লেটের ঝুড়িতে মিলল নবজাতকের মরদেহ

১০

২৫ এপ্রিল : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১১

ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে ছাত্রীকে হত্যা করে বেলাল

১২

পাকিস্তানে বিক্ষোভ / ‘ভারত আক্রমণ করলে কাশ্মীরিরাই প্রথম সারিতে লড়বে’

১৩

কাশ্মীর সীমান্তে দুপক্ষের গোলাগুলি

১৪

রাজধানীতে ঝুটের গুদামে আগুন

১৫

বার কাউন্সিল পরীক্ষা আজ, ভুয়া প্রশ্নপত্র ছড়ানোয় গ্রেপ্তার ১

১৬

ধৈর্য ধরবে কি ভারত-পাকিস্তান?

১৭

৯ মাস পর শহীদ মিঠুর মরদেহ উত্তোলন

১৮

২৫ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৯

সামরিক শক্তি দেখাতে নেমেছে ভারত-পাকিস্তান

২০
X