ড. হারুন-অর-রশিদ 
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৩, ০২:১২ এএম
আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ০৫:৩১ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ড. হারুন-অর-রশিদ-এর সাক্ষাৎকার

বর্জন নয়, বরং নির্বাচনে আসাই বিএনপির জন্য সঠিক হবে

অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ
অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ

অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইবারের সাবেক উপাচার্য। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সিলেকশান গ্রেডের একজন অধ্যাপক ও উপ-উপাচার্য ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বি.এ. (অনার্স) এবং মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। পরে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডব্লিউ এইচ মরিস-জোনস-এর তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন। এছাড়া তিনি সুইডেনের উপসালা (শান্তি ও সংঘাতের উপর) ও জাপানের রিউকোকু (কিওটো) বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করেন। ১৯৪৭-পূর্ব ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন অবিভক্ত বাংলা, পাকিস্তানি শাসনকাল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সমসাময়িক ভারত ও বাংলাদেশের রাজনীতি, এর গতিধারা ও রাজনৈতিক উন্নয়ন’ তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র। বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণায় অবদান রাখার জন্য ২০২১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

কালবেলা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছে ৫২ বছর। আমরা এখন গণতন্ত্র বিকাশের কোন স্তরে রয়েছি?

ড. হারুন-অর-রশিদ গণতন্ত্র আমাদের লক্ষ্য এবং আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু এখনো আমরা আমাদের গণতন্ত্রের সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। একটা দেশের গণতন্ত্র বিকাশের প্রস্তুতির সময় প্রয়োজন। অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়েও আমরা ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছি। ইংরেজিতে যেটাকে বলা হয় Fledgling Democracy। অর্থাৎ যে পাখি এখনো উড়েনি, কিন্তু উড়তে চেষ্টা করছে— আমরা গণতন্ত্রের ঠিক সেই জায়গায় রয়েছি। একটা পাখির ডানায় যেমন পালক গজায় এবং তারপরে সে উড়তে শিখে, তেমনি বাংলাদেশ গণতন্ত্রের সেই পালক গজানোর সময়ের যে পর্যায়ে রয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে অনেক বড় বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরিক আর্দশভিত্তিক বিপরীত ধারায় বিভক্ত এবং এর রূপ হচ্ছে সাংর্ষিক। এটিই হলো বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র চর্চা, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের আবির্ভাব। একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের সবকিছুই নতুন করে গড়ে তুলতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব না থাকলে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে যেত। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ, যার এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রিত। রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবকিছুই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বলতে কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। খাদ্য গুদাম শূন্য। এরকম একটি শূন্য অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি জনগণের ভালোবাসা ও বিশ্বাস এবং জনগণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পৃক্তির ফলেই বাংলাদেশকে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের একটি ভিত্তি প্রদান করে গেছেন বঙ্গবন্ধু। আজ বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বলতে যা কিছু রয়েছে তার প্রায় সবই বঙ্গবন্ধুর হাতে ভিত্তিপ্রস্থ স্থাপন করা অথবা তিনি গড়ে দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ আজকে একটি সম্ভাবনাময় দেশে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের এলডিসি থেকে স্বল্পোন্নত দেশ এবং এখন আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আমরা অনেক আগেই এটা অর্জন করতে সক্ষম হতাম।

১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা আমাদের জাতির জন্য একটি চরম বিপর্যয় নিয়ে আসে। এরপর বাংলাদেশে দীর্ঘ ১৫ বছর সেনা শাসনের অধীনে ছিল। ১৯৯১ সালে একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে সিভিলিয়ান সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। ১৯৯৬ সালে এসে আবার আমরা সংকট দেখতে পেলাম। নির্বাচন ব্যবস্থাসহ বঙ্গবন্ধু যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো তৈরি করেছিলেন, সেনা শাসনামলে সেই কাঠামোগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তারা দল গঠন করেন রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা, প্রশাসন কাঠামো এবং সামরিক বাহিনীর ইন্টেলিজেন্স গ্রুপগুলোকে ব্যবহার করে। সে সঙ্গে বিভিন্ন দল ভেঙ্গে এবং এন্টি আওয়ামী লীগ শক্তিগুলোকে একত্রিত করে তারা দল গঠন করেছিলেন। এই দলগুলো মাটি ও মানুষের কাছ থেকে গড়ে ওঠেনি বরং উপর থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এই দলগুলোকে মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জেনারেল জিয়া ও এরশাদ ক্ষমতাসীন হয়ে এক পর্যায়ে হ্যাঁ/না ভোটের নির্বাচন পর্যন্ত করেছিলেন। এর আগে পাকিস্তান আমলে জেনারেল আইয়ুব খান এই ধরনের হ্যাঁ/না ভোটের নির্বাচন করেছিলেন। সেই হ্যাঁ/না ভোটে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিল না। অথচ সেসব নির্বাচনে তারা ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পেয়েছিলেন। এটাকে বলা হয় ব্যালট স্টাফিং অর্থাৎ ব্যালট কেটে ব্যালট বক্সে ভরে দেওয়া।

আজকে আমাদের নির্বাচন নিয়ে যে সংকট এবং গণতন্ত্রর চর্চা নিয়ে যে সংকট সেটার মূলে ৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের সেনা শাসন। সেনা শাসন থেকে উত্তরণের জন্য আসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারণাটি। সে সময় নির্বাচন কমিশন এতটা শক্তিশালী ছিল না অথবা নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি এতটা শক্ত ছিল না। সকল দলের বয়কটের পরেও ৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়াই নির্বাচন করে বিএনপি। কিন্তু জনগণের গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। সে সময় বিএনপি'র সেই একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে জনতার মঞ্চের সৃষ্টি হয়। সচিবালয়সহ বিভিন্ন পেশার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাস্তায় নেমে আসেন। এ সময় আইন পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে একটি সাংবিধানিক রূপ দেওয়া হয়।

এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। এবং সেই নির্বাচনগুলো অবশ্যই ভালো হয়েছে। সেই নির্বাচনগুলোতে যারা হেরে গেছে কখনো কখনো তারা প্রশ্ন তুলেছে কিন্তু মোট কথা নির্বাচন গুলো গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য তারা সংবিধানে একটি সংশোধনী নিয়ে আসে। এই চতুর্দশ সংশোধনীতে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে বাড়ি ৬৭ করা হয়। এই সংশোধনীর লক্ষ্য ছিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান যিনি একসময় বিএনপি'র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানানো। অর্থাৎ বিএনপি-জামাত জোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে দলীয়করণ করার চেষ্টা করে। ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারেনি তারা। কিন্তু হঠাৎ করে তৎকালীন বিএনপি জামাত জোট দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধাপ গুলোকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কাজেই যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল তার ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত হেনেছে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী।

কালবেলা: ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?

ড. হারুন-অর-রশিদ: ২০১০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক উল্লেখ করে রায় দেয় উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক। আর বাংলাদেশের সংবিধান গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থাকে অনুমতি দেয় না। ফলে ২০১১ সালে সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামাত এবং তাদের সহযোগী দল গুলো নির্বাচন বর্জন করে। শুধু নির্বাচন বর্জন করে তারা ক্ষান্ত হয়নি, তারা নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য সহিংসতা চালায়। সেই সহিংসতায় ৫০০ এর বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৫ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের এক বছর পূর্তিতে অসহযোগ আন্দোলনের নামে অরাজকতা শুরু করে বিএনপি জামাত এবং তাদের সহযোগীরা। তারা দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছে। আর এসবের ফলে বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ২০১৪ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি। এ কারণে ১৫৩ জন সদস্য বিনা প্রতিদ্বদ্বিতায় নির্বাচিত হয়। কাজেই ২০১৪ সালে নির্বাচনে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তার প্রধান দায়-দায়িত্ব বিএনপির ওপর বর্তায়। ২০১৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের অধীনে যে নির্বাচন আয়োজন করা হয় সেখানে অংশগ্রহণ করে বিএনপি। বিএনপি সেসময় বিশৃংখল অবস্থায় ছিল এবং নির্বাচন কেন্দ্রিক দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের ব্যাপক দুর্বলতা ছিল। একটি দল যেভাবে সুসংহত ভাবে নির্বাচনে যায় বিএনপি সেভাবে নির্বাচনে যেতে পারেনি। বিএনপি একবার ডঃ কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট গঠন করে, আবার সেই জোট থেকে বের হয়। ফলে বিএনপির কোন নির্দিষ্ট কর্মসূচি ছিল না। যে কারণে বিএনপি সেই নির্বাচনে মাত্র সাতটি আসন লাভ করে। ভোট সুষ্ঠু হয়েছে কিনা, জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে কিনা এসব বিষয় নিয়ে তখন দেশ-বিদেশে প্রশ্ন দেখা যায়। কিন্তু মূল বিষয় হলো- বিএনপি'র ৬ জন সংসদ সদস্য শপথ গ্রহণ করেন। আবার চার বছর ওই সংসদে থাকার পর হঠাৎ করে তারা সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। ওই সংসদকে ‘অবৈধ’ বলে আখ্যায়িত করে হঠাৎ করে তারা পদত্যাগ করে। বিএনপির এই অবস্থান স্পষ্টতই স্ববিরোধী। নির্বাচনের পরপরই বিএনপি নির্বাচনে কারচুপির বিষয়ে কিছু বলেনি। বিএনপি শুধু পাওয়ার সেন্ট্রিক পলিটিক্স করছে। বিএনপি'র এখন ভিন্ন কতগুলো এজেন্ডা রয়েছে যা জনগণের এজেন্ডা নয়। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে যে পরিচ্ছন্ন নৈতিক এবং আদর্শিক জায়গাটি থাকতে হয় সেটি বিএনপির নেই। তারা জনগণের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। এসব কারণে জনগণ আর তাদের সাথে নেই। এখন তারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা আন্তর্জাতিকভাবে লবিস্ট নিয়োগ করছে এবং এক ধরনের আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। একই সাথে তারা এখন দেশের অভ্যন্তরে প্রথমে ৩১ দফা, এরপর ১০ দফা এবং সর্বশেষ এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছে। তারা বিভাগীয় সমাবেশ করেছে, তারুণ্যের সমাবেশ করেছে। নির্বিঘ্নে এসব সমাবেশগুলো হয়েছে।

কালবেলা: বিএনপি বলেছে তারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না এবং এক দফা দাবিতে তারা আন্দোলন করছে। এই অবস্থায় আগামী নির্বাচন কেমন হবে বলে মনে করেন?

ড. হারুন-অর-রশিদ: বিএনপি যে এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছে সেই এক দফার মানে হল- প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্দলীয় ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে তারপর নির্বাচন। এই এক দফার দাবি শুধু বিএনপি নেতাকর্মী এবং অন্যান্য কতগুলো ছোট ছোট দলের দাবি। এটা গণমানুষের দাবী নয়। এটা যদি জাতীয় দাবী হতো তাহলে বিভিন্ন পেশার মানুষ এবং নির্বিশেষে সকলেই রাজপথে নেমে আসত। এমন অবস্থা আমরা দেখেছি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়। এমন অবস্থা দেখেছি মধ্য ফেব্রুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী সময়ে। কিন্তু সেই অবস্থা এখন দেশে বিদ্যমান নেই। আর এর কারণ হলো বিএনপি'র প্রতি জন মানুষের আস্থার সংকট। মানুষ বিএনপি'র উপর ভরসা করতে পারে না। ফলে বিএনপি এখন যে এক দফার দাবি করছে সেটা সরকার শুনবে তার কোন কারণ নেই।

আমাদের দেশে একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া রয়েছে। সবকিছুতে হাত দিতে নেই। সাংবিধানিক প্রক্রিয়াতেও যদি হাত দেওয়া হয় তাহলে দেশে চরমভাবে একটি অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হবে। সুতরাং সংবিধানের মধ্যে থেকে দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। সম্ভব হলে সেই নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক করতে হবে। কারণ বিএনপি যদি এক দফায় অনড় থাকে তাহলে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না।

গণঅভ্যুত্থান ছাড়া বিএনপি'র এই এক দফা বাস্তবায়িত হওয়ার কোন উপায় নেই। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের কোনো সম্ভাবনা বাংলাদেশে নেই। সুতরাং বিএনপির হাতে এখন দুইটি অপশন থাকে। একটি হল- নির্বাচন বর্জন করা এবং নির্বাচনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করা। আর অন্যটি হলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা।

কালবেলা: আগামী নির্বাচন ২০১৪ এবং ২০১৮ এর মত হবে না তার নিশ্চয়তা নেই বলে জানাচ্ছে বিএনপি...

ড. হারুন-অর-রশিদ: নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। প্রথমত, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক দেশ এমনকি জাতিসংঘ গভীরভাবে বাংলাদেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। অর্থাৎ তারা এক ধরনের মনিটরিং করছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে এরকম কোন মনিটরিং ছিল না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মানুষ চাচ্ছে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি আসনে উপনির্বাচন হল, পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হলো, স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলো। সবগুলো নির্বাচনই হয়েছে স্টান্ডার্ড মানের। বাংলাদেশে এর চেয়ে ভালো নির্বাচন বিগত দিনে কখনো হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কাজেই বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার নিরিখেই আমাদের প্রত্যাশা থাকতে হবে।

কালবেলা: বাংলাদেশে কি নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে?

ড. হারুন-অর-রশিদ: নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের মা কিভাবে নির্বাচিত হন? সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান নির্বাচনে হেরে গেছেন। বিগত দুই তিন বছরে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে কোথাও ব্যালট কেটে বাক্সে ঢোকানোর অভিযোগ করা হয়নি। হিরো আলমের উপর হামলার ক্ষেত্রেও কেউ নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন সুষ্ঠু করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেনি। প্রশ্ন তুলেছিল নির্বাচন কমিশনের নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে। নিরাপত্তা দিতে হলে রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারসাম্য প্রয়োজন। আর সেই ভারসাম্য তৈরি করতে হলে বড় দলগুলোকে নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি'র মত বড় দলগুলো নির্বাচনে আসলে নির্বাচনে একটি ভারসাম্য পরিস্থিতি তৈরি হবে। একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে। তখন নিরাপত্তার জায়গাটিও অনেক সহজে রক্ষা করা যাবে। এছাড়া আওয়ামী লীগের উপরেও এক ধরনের চাপ রয়েছে। জনগণ যদি ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারে, নির্বাচন যদি অবাধ ও সুষ্ঠু না হয় অর্থাৎ বারবার যদি একই ধরনের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে জনঅসন্তোষ একসময় গণবিদ্রোহে রূপ লাভ করতে পারে। একদিনে কখনো গণ বিপ্লব ঘটে না। তাই বিএনপি'র এক দফা আন্দোলন সফল হওয়ার কোন কারণ দেখি না। বিএনপিকে একটা কাজই করতে হবে, তা হলো এক দফার আন্দোলন থেকে সরে এসে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। নির্বাচন কিভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা যায় সেই ব্যাপারে তারা সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে পারে। সরকার বিরোধী দলসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা পেলে এ নির্বাচন কমিশনের পক্ষে একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব বলে আমি মনে করি।

কালবেলা: বিএনপি'র এক দফা আন্দোলনের কোন সফলতার সম্ভাবনা কি দেখেন?

ড. হারুন-অর-রশিদ: বিএনপি'র এক দফা আন্দোলনের মানে হল প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সরকারের পদত্যাগ এবং আবার একটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া। এটা অসাংবিধানিক। তাই এর কোন সফলতা আমি দেখি না। বিএনপিকে প্রথমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। তারপর সেই নির্বাচন যদি অবাধ ও সুষ্ঠু না হয়, যদি নির্বাচনে জনগণের মতের প্রতিফলন না ঘটে, যদি নির্বাচনে সরকারের হস্তক্ষেপ হয় তখন তারা তাদের এক দফাতে আন্দোলন শুরু করতে পারে। তখন বিএনপি'র এই বক্তব্য আরও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তখন তাদের এই এক দফার বক্তব্য জাতীয় দাবিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তাই এই ধাপগুলো অতিক্রম না করে বিএনপি সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করতে পারে না। সরকারের উপর নানা ধরনের চাপ এবং নির্বাচন সুষ্ঠু করার এক ধরনের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করলে বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে তাদের উপর ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে আমেরিকা। এর মধ্যে ভিসানীতির আংশিক প্রয়োগও দেখা গেছে। সবদিক দিয়ে সরকার এবার একটি ভালো নির্বাচন করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে বিএনপি যে দাবি করছে, নির্বাচন হওয়ার আগে এমন দাবির কোনো ভিত্তি নেই। তাই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কিভাবে করা যায় সেদিকে এগিয়ে আসতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজকের নামাজের সময়সূচি

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

১০

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১১

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১২

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১৩

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৪

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৫

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৬

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৭

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৮

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

১৯

‘এক ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে আরেক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’

২০
X