কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৭ এএম
আপডেট : ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মাওলানা আব্দুর রহমান

রজবে বইছে পবিত্র রমজানের আগমনী বাতাস

রজবে বইছে পবিত্র রমজানের আগমনী বাতাস

হিজরি ক্যালেন্ডারের শ্রেষ্ঠতম মাস পবিত্র রমজান। বিশ্বজুড়ে লক্ষ-কোটি মুসলমান প্রতীক্ষায় থাকেন রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের রমজান মাসের। রজব মাস যেন এ অপেক্ষার তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দেয়। কারণ রজব এবং পবিত্র রমজানের মাঝখানে শুধু একটি মাস বিদ্যমান, তা হলো—শাবান। রজব মাস থেকেই বইতে শুরু করে পবিত্র মাহে রমজানের বাতাস। রাসুল (সা.) রজব থেকেই পবিত্র রমজানের প্রস্তুতি শুরু করতেন। রজব এলেই ইবাদতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। তাই পবিত্র রমজানের ইবাদতের পূর্ণ প্রস্তুতি রজব থেকেই শুরু হওয়া চাই। কোরআন ও হাদিসে পবিত্র রজব মাসের তাৎপর্য ও গুরুত্ব উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহতায়ালা ১২ মাসের মধ্যে চারটি মাসকে ‘আশহুরে হুরুম’ তথা সম্মানিত ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কোরআনে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস ১২টি আসমানগুলো ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকে। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোয় নিজেদের প্রতি অত্যাচার কোরো না।’ (সুরা তাওবা : ৩৪)।

সম্মানিত চার মাসের একটি হলো—রজব। হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘১২ মাসে বছর। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক—জিলকদ, জিলহজ, মহররম আর চতুর্থটি হলো রজব।’ (সহিহ বোখারি)।

এ মাসগুলোকে হারাম মাস বলার দুটি কারণ—১. এ মাসে হত্যা, মারামারি-কাটাকাটি, যুদ্ধ-বিগ্রহ হারাম। ২. এ মাসগুলো বরকতময়। ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, আশহুরে হুরুমের বৈশিষ্ট্য হলো—এসব মাসে ইবাদতের প্রতি যত্নবান হলে বাকি মাসগুলোতে ইবাদতের তওফিক হয় বেশি বেশি। আশহুরে হুরুমে কষ্ট করে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারলে অন্যান্য মাসেও গুনাহ পরিহার করা সহজ হয়। (আহকামুল কোরআন, জাসসাস: ৩/১১১)।

ইবাদতের শ্রেষ্ঠ মাস রমজানের আগমনী বার্তা দেয় রজব। এ মাস শুরু হলে নবীজি (সা.) পবিত্র রমজান পাওয়ার জন্য বেশি বেশি দোয়া করতেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) রজব এলে বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিগনা রামাদান’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, রজব ও শাবান মাসে আমাদের জন্য বরকত নাজিল করুন এবং রমজান আমাদের নসিব করুন।’ (আল-মুজামুল আওসাত: ৩৯৩৯)।

প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ মোল্লা আলি কারি (রহ.)-এর মতে, দোয়াটির মর্মার্থ হলো—এ মাসগুলোতে আমাদের আনুগত্য ও ইবাদতে বরকত দান করুন। আমাদের বয়স দীর্ঘ করে রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন। যাতে রমজানের রোজা এবং তারাবিসহ ইত্যাদির সৌভাগ্য অর্জন করতে পারি (মিরকাতুল মাফাতিহ: ৩/১০২২)। হাদিসে আরও বলা হয়েছে, রজব মাস থেকে নবী করিম (সা.) রমজানের প্রস্তুতিস্বরূপ রোজা রাখা শুরু করতেন। বস্তুত হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এ দোয়ার মাধ্যমে রজব মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেছেন।

রজব মাসের প্রথম রাতে দোয়া কবুল হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘পাঁচটি রাত এমন আছে যাতে দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না—১. জুমার রাত, ২. রজবের প্রথম রাত, ৩. ১৫ শাবানের রাত, ৪. ঈদুল ফিতরের রাত ও ৫. ঈদুল আজহার রাত।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭৯২৭)। এ মাসের ইবাদতে সওয়াব অন্য মাসের তুলনায় বেশি। এ সম্পর্কে মুফতি শফি (রহ.) বলেন, ‘সব নবী-রাসুলের শরিয়ত এ বিষয়ে একমত যে, এ চার মাসের প্রত্যেকটা ইবাদতের সওয়াব বেশি। এর মধ্যে কোনো গুনাহ করলে এর পরিণতি ও শাস্তিও বেশি।’ (মাআরিফুল কোরআন: ৪/৩৭)। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এ মাসের ব্যাপারে মানুষ বেশ কিছু ভুলের শিকার। বিশেষ করে দুটি বিষয় লক্ষণীয়—

শবেমেরাজে আমল: রজবের ২৭ তারিখে (২৬ তারিখ রাত) নবীজি (সা.) মেরাজ বা ঊর্ধ্বাকাশে ভ্রমণ করেন। যদিও কিছু বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, নবী (সা.) মেরাজে যান রবিউল আউয়াল মাসে। মেরাজে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দিদার লাভ করেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম নিয়ে দুনিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেখানে অবলোকন করেন সৃষ্টিজগতের অপার রহস্যময় অনেক বিষয়। এসব কারণে মুসলিম উম্মাহর কাছে এ মাসের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য অনেক বেশি।

শবেমেরাজের রাত মহানবীর ঊর্ধ্বাকাশ ভ্রমণের কারণে বিশেষ মাহাত্ম্যের হলেও এ রাতে বিশেষ কোনো আমল নেই ইসলামে। কারণ, মেরাজের ঘটনা নবুওয়াতের পঞ্চম বছরে ঘটেছে। যার অর্থ হলো, এ ঘটনার পর ১৮ বছর পর্যন্ত নবী (সা.) দুনিয়ায় ছিলেন; কিন্তু এ দীর্ঘ বছরগুলোতে কোথাও এ কথা প্রমাণিত নেই যে, তিনি মেরাজের রাতে কোনো বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন কিংবা উদযাপন করার মতো কিছু বলেছেন। না নবীজির কোনো বক্তব্য এ ব্যাপারে আছে; না তার সময়কালে এ রাতে জাগ্রত থাকার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে; না তিনি নিজে জাগ্রত থেকেছেন; না সাহাবায়ে কেরামকে এর প্রতি তাকিদ করেছেন; না সাহাবায়ে কেরাম নিজেরা এর প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই এ রাতে ইবাদতের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া বিদআত। তাই তা বর্জনীয়। (ইসলাহি খুতুবাত: ১/৬০-৬২)।

২৭ রজব রোজা: কিছু মানুষ রজবের ২৭ তারিখের রোজা রাখার প্রতি অনেক গুরুত্ব দেয়। রোজাটিকে অনেক ফজিলতপূর্ণ মনে করে। অথচ এ রোজার ব্যাপারে সহিহ সূত্রে একটি বর্ণনাও প্রমাণিত নয়। ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেছেন, রজব মাসে বিশেষ করে মেরাজের কারণে কোনো রোজার বিশেষ ফজিলত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয় (তাবয়িনুল আজাব, পৃষ্ঠা: ১১)। এ ছাড়া হজরত ওমর (রা.)-এর আমল পাওয়া যায় যে, তিনি স্বীয় খেলাফতকালে যখন দেখতে পেলেন, ২৭ রজবে মানুষ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে রোজা রাখছে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হলেন এবং একজন লোককে গিয়ে জোরপূর্বক বললেন, আমার সামনে খাও এবং এ কথার প্রমাণ দাও যে, তোমরা রোজাদার না। হজরত খুরাশা ইবনুল হুর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হজরত ওমর ইবনে খাত্তাবকে দেখেছি, তিনি রজব মাসে রোজা রাখার কারণে লোকদের হাতে পেটাতেন। এমনকি তাদের খাওয়ায় বসিয়ে দিতেন এবং বলতেন, রজব! রজব কী? রজব মাস যাকে জাহেলি যুগে লোকেরা বিশেষ সম্মান করত; কিন্তু ইসলাম এসে বিষয়টা প্রত্যাখ্যান করেছে।’ (কানজুল উম্মাল: ২৪৫৭৫)।

তবে রমজান যেহেতু সিয়াম, কিয়াম ও কোরআন নাজিলের মাস, তাই রমজানের আমলের ওপর ভিত্তি করে পবিত্র রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে এসব আমল রজব থেকেই শুরু করা যায়। রজব মাস আমাদের হৃদয়ের জমিনে ইমান ও তাওহিদ চাষাবাদের উৎকৃষ্ট সময়। একজন চাষি যেমন তার দীর্ঘদিনের পরিত্যক্ত জমির শুকনো মাটি খুঁড়ে পানি সেচন করে মাটিকে নরম ও চাষাবাদের উপযোগী করে তোলেন, তেমনিভাবে দুনিয়ার ব্যস্ততার কারণে বান্দার দীর্ঘদিন আল্লাহর জিকির ও ইসতেগফার হতে গাফেল থাকার ফলে বান্দার হৃদয় শুকনো জমির মতো অন্তঃসারশূন্য হয়ে যায়। তাই রজব মাসেই বেশি বেশি জিকির ও ইসতেগফারের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ের জমিনকে নরম ও উর্বর করতে হবে। যাতে পবিত্র রমজানে পরিপূর্ণ ইবাদতের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের হৃদয়ে আল্লাহর একত্ববাদের চাষাবাদ করতে পারি। এ ছাড়া কোনো কাজ উত্তমরূপে সম্পাদন করতে হলে আগেই তা অনুশীলন করে অভ্যস্ত হতে হয়। রজব ও শাবান মাস হচ্ছে পবিত্র রমজান মাসের ইবাদত-বন্দেগির অনুশীলনের মাস। এ মাস থেকেই নিয়মিত আমলের অভ্যাস করে নেওয়া সুচিন্তার দাবি। সুন্নাহভিত্তিক আমল করে কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকাও জরুরি। আল্লাহ তওফিক দান করুন।

লেখক: ইমাম ও খতিব

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হলেন কালবেলার হারুন ও তুরাজ

শাহজালালে ফের হুমকির বার্তায় নিরাপত্তা জোরদার

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটকে সহযোগিতা করবে এফবিআই

দমনমূলক রাষ্ট্রকাঠামো বদল করতে হবে : আ স ম রব

মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ সফরে আসবেন ফিফা প্রধান

সিকৃবির ভেটেরিনারি শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন

পুরোহিতের বাড়ি ভাঙচুর-লুটপাট ও জমি দখলের অভিযোগ

তিন মাসে কিছুই করা সম্ভব নয় : শিক্ষা উপদেষ্টা

ক্রিপ্টো কারেন্সিকে জাকাতের অন্তর্ভুক্ত করল মালয়েশিয়া

এনআইএসটির নবীন শিক্ষার্থীদের বরণ ও পুরস্কার বিতরণ

১০

বিএনপির ইউনিয়ন অফিস ভাঙচুর

১১

‘আগামী ২০ বছর রাজনীতিতে তরুণরা প্রভাব ফেলবে’

১২

খুলনাকে হারিয়ে প্লে-অফের কাছে বরিশাল

১৩

বিদায় অনুষ্ঠানে ঢুকতে বাধা দেওয়ায় শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পেটাল বহিষ্কৃতরা

১৪

আ.লীগকে তৃতীয়বার গণহত্যার সুযোগ দেওয়া হবে না : রাশেদ খান

১৫

বিএনপি নেতারা শেষ পর্যন্ত মাঠে ছিল : জুয়েল

১৬

জাবির হলে লুকিয়ে থাকা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৭

বিএনপি নেতা তানভীর ও সাইফুলের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার

১৮

দাভোসে বৈঠকে তুলে ধরবেন প্রধান উপদেষ্টা / বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ উপযুক্ত স্থান

১৯

সিঙ্গাপুর গেলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ

২০
X