বিশাল ভারতবর্ষ শাসনকারী মোগল রাজপরিবার ছিল সর্বগুণে গুণান্বিত। পরিবারের সদস্যরা সাহিত্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান, সংগীত, কাব্য, স্থাপত্য, রন্ধন ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই রেখেছেন বিস্ময়কর অবদান। পরিবারের নারী সদস্যরাও ছিলেন সমান অগ্রসর। প্রতাপশালী মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের কন্যা জেবুন্নেসা এমনই একজন ধ্রুবতারা। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, সাহিত্যিক, সুফি ও কোরআনের হাফেজ। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পুরো কোরআন হিফজ করেন। ‘দিওয়ানে মাকফি’ তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। রাজকন্যা হয়েও তিনি সাধকের মতো জীবন কাটাতেন।
জেবুন্নেসা ছিলেন মোগল সম্রাট আলমগীরের বড় মেয়ে। তার মা দিলরাস বানু বেগম ছিলেন শাহ নেওয়াজ খানের কন্যা। ১০৪৮ হিজরির শাওয়াল মাসে (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) জেবুন্নেসার জন্ম হয়। জেবুন্নেসার বাল্যকাল কাটে হেসেখেলে। পড়ার বয়সে উপনীত হলে আলমগীর তার শিক্ষার জন্য আমির এনায়েতুল্লাহ খানের মা হাফেজ মরিয়ম বেগমকে নিযুক্ত করেন। মরিয়ম বেগম কোরআনের হাফেজ ছিলেন। লেখাপড়া জানতেন। জেবুন্নেসা মরিয়ম বেগমের কাছে পড়াশোনা শুরু করে। প্রথমেই তাকে কোরআন হিফজ করানো হয়। জেবুন্নেসা উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার মেধা, বুদ্ধি ও সাহিত্য রুচি লাভ করেছিলেন। তিনি সাত বছর বয়সে কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। হিফজ শেষ করতে তার সময় লেগেছিল মাত্র তিন বছর। কন্যা কোরআন হিফজ করায় সম্রাট আওরঙ্গজেব মহাউৎসবের আয়োজন করেন এবং রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করেন। জেবুন্নেসা ও তার শিক্ষিকাকে ৩০ হাজার করে স্বর্ণমুদ্রা উপহার দেন।
কোরআন চর্চায় জেবুন্নেসা বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। কোরআনের হাফেজ এ মোগল শাহজাদি ‘জিবুত তাফাসির’ নামে একটি তাফসির গ্রন্থ রচনা করেন, যা নারীদের রচিত প্রথম তাফসির গ্রন্থ। অবশ্য সাইয়েদ আবদুল হাই হাসানি (রহ.) ‘নুজহাতুল খাওয়াতির’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘জিবুত তাফসির মূলত ইমাম রাজি (রহ.)-এর তাফসিরে কবিরের ফারসি অনুবাদ, যা শায়খ শফিউদ্দিন কাজভিনি (রহ.) জেবুন্নেসার নির্দেশে রচনা করেন। ফলে তার নামে নাম রাখা হয়।’ জেবুন্নেসা আররি ও ফারসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। এমনকি সে যুগের বড় বড় জ্ঞানীও নানা প্রয়োজনের জেবুন্নেসার দ্বারস্থ হতেন। জেবুন্নেসার ওস্তাদদের মধ্যে মোল্লা সাইদ আশরাফ উল্লেখযোগ্য। মোল্লা সাইদ আশরাফ আলমগীরের শাসনামলের শুরুর দিকে ইরান থেকে ভারতবর্ষে আসেন। আলমগীর তাকে জেবুন্নেসার শিক্ষক নিযুক্ত করেন। সে সময় জেবুন্নেসার বয়স একুশ বা বাইশ। এ থেকে বোঝা যায় আলমগীর তার এ কন্যার শিক্ষার ব্যাপারে কতটা যত্নশীল ছিলেন। মোল্লা সাইদ আশরাফ কবি ছিলেন। মোল্লা সাইদের তত্ত্বাবধানেই জেবুন্নেসা কাব্যচর্চা করেন। প্রায় ১৩-১৪ বছর জেবুন্নেসা মোল্লা সাইদ আশরাফের তত্ত্বাবধানে নানা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ১০৮৩ হিজরিতে মোল্লা সাইদ আশরাফ ভারতবর্ষ ত্যাগ করে ইরান গমনের মনস্থ করেন। সে সময় একটি কবিতার মাধ্যমে তিনি জেবুন্নেসার কাছ থেকে বিদায় নেন। রাজকন্যা জেবুন্নেসা একজন লিপিকার ও ক্যালিগ্রাফি শিল্পীও ছিলেন। বইপ্রেমী শাহজাদি জেবুন্নেসা বই লেখা ও মূল্যবান বইয়ের অনুলিপি তৈরি করতে একাধিক আলেম ও পণ্ডিত ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেছিলেন। তার ব্যক্তিগত পাঠাগারটি ছিল খুবই সমৃদ্ধ। শাহজাদি জেবুন্নেসা ছিলেন একজন দানশীল নারী। তিনি দরিদ্র, অসহায়, বিধবা ও এতিমদের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেন। প্রতি বছর তিনি বহুসংখ্যক মানুষকে হজে পাঠাতেন। সংগীতের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি নিজেও মরমি গান গাইতেন। সমকালীন নারীদের ভেতর তাকে শ্রেষ্ঠ গায়িকা মনে করা হয়। আওরঙ্গজেব যখন সম্রাট হন, তখন জেবুন্নেসার বয়স ২১ বছর। তিনি তার মেয়ের মেধা ও বিচক্ষণতা সম্পর্কে জানতেন। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করতেন এবং মতামত নিতেন। একাধিক বিষয়ে দক্ষতা থাকলেও জেবুন্নেসা মূলত একজন কবি হিসেবেই পরিচিত। তার ভারতীয় ধারার ফারসি কবিতার অন্যতম প্রধান কবি মনে করা হয়। সাহিত্যে তিনি হাফেজ সিরাজি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কবিতা রচনার পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু মরমি গানও রচনা করেছেন। তিনি ‘মাখফি’ নামে কবিতা লিখতেন। ‘দিওয়ানে মাখফি’ তার কাব্যসংকলন, যাতে পাঁচ হাজার পঙক্তি রয়েছে। অবশ্য মাখজানুল গায়েব গ্রন্থকারের দাবি, জেবুন্নেসার মোট পঙক্তির সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। দেখতে অনিন্দ্য সুন্দরী হলেও জীবনযাপনে ছিলেন সাদাসিধে। একটি মুক্তার গলার হার ছাড়া তিনি কোনো অলংকার ব্যবহার করতেন না। সবসময় সাদা পোশাক পরিধান করতেন। তিনি ‘আঙ্গিয়া কুর্তি’ নামে মেয়েদের একটি বিশেষ পোশাক উদ্ভাবন করেন। বাগান স্থাপন ও বৃক্ষরোপণ ছিল তার প্রিয় একটি কাজ। লাহোরে তার প্রতিষ্ঠিত চৌবুর্জি বাগানের অস্তিত্ব এখনো টিকে আছে। জেবুন্নেসা বিয়েও করেননি। সারা দিন পড়াশোনাতেই ব্যস্ত থাকতেন। সমকালীন রাজনীতি থেকে ছিলেন দূরে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, তাকেও রাজনীতির মরণফাঁদে আটকা পড়তে হয়। ১০৯১ হিজরিতে রাজপুতরা বিদ্রোহ করে। আলমগীর এই বিদ্রোহ দমনের জন্য শাহজাদা আকবরকে সসৈন্যে যোধাপুর প্রেরণ করেন। কিন্তু রাজপুতদের প্ররোচনায় শাহজাদা আকবর নিজেই পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। এ সময় জেবুন্নেসার সঙ্গে শাহজাদার পত্রালাপ চলত। এই পত্রালাপ রাজনৈতিক ছিল না, শুধুই ভাইবোনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। ঘটনাচক্রে দুয়েকটি পত্র ধরা পড়ে এবং আলমগীর জানতে পারেন জেবুন্নেসা ভাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। আলমগীর ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে যান। জেবুন্নেসার বার্ষিক ভাতা, যা ছিল চার লাখ স্বর্ণমুদ্রা, তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। জেবুন্নেসার সব সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়। জেবুন্নেসাকে সেলিমগড়ে বন্দি করা হয়। তবে শিগগিরই জেবুন্নেসা নির্দোষ প্রমাণিত হন। তাকে আবার সব ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সম্রাটের সঙ্গেও তার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়।
১১১৩ হিজরিতে, আলমগীরের শাসনামলের ৪৮ বছর চলছে তখন, জেবুন্নেসা দিল্লিতে মৃত্যুবরণ করেন। আলমগীর সে সময় দক্ষিণাত্যে, একের পর এক যুদ্ধে ব্যস্ত। প্রিয় কন্যার মৃত্যু সংবাদে তিনি ভেঙে পড়েন। তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়। শান্ত, ধীর স্বভাবের এই সম্রাট নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। পরে তিনি শায়খ আতাউল্লাহ, সাইয়েদ আমজাদ খান ও হাফেজ খানের কাছে লিখিত পত্রে মরহুমার ইসালে সওয়াবের জন্য দান খয়রাতের নির্দেশ দেন। এ ছাড়া মরহুমার কবর পাকা করারও নির্দেশ দেন। ভারতবর্ষে ইতিহাসে জ্ঞানসাধনার উজ্জ্বল ধ্রুবতারা হয়ে বিরাজ করছেন রাজকন্যা জেবুন্নেসা। একই সঙ্গে তিনি নারী শিক্ষারও এক সমুজ্জ্বল নক্ষত্র।