পৃথিবীতে মানুষের জীবন অল্প সময়ের। সময় শেষ হলেই মৃত্যুর মাধ্যমে পরকালের পথে যাত্রা করতে হবে। এ বিষয়টি নবীজি তার সাহাবি ইবনে ওমরকে লক্ষ্য করে এভাবে বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে তুমি এমনভাবে দিন যাপন করো যেন একজন আগন্তুক অথবা একজন মুসাফির।’ (বোখারি হা/৬৪১৬)। কারণ আমরা সবাই মূলত ছিলাম রুহের জগতে। অতঃপর মাতৃগর্ভে এবং সেখানে থেকে এ দুনিয়ায়। প্রতিটি স্তরে আল্লাহর হুকুমে আমাদের আগমন ও প্রত্যাগমন হয়েছে এবং হবে। ইচ্ছা করে আমরা কোনো একটি যাত্রাপথে নির্দিষ্ট কাল অপেক্ষা দ্রুত করতে পারি না, বিলম্বও করতে পারি না (সুরা নাহল: ৬১)। আমাদের বর্তমান অবস্থান এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ যাত্রাপথে, যেটা পরকালীন সব যাত্রাপথের জন্য পাথেয় সঞ্চয়ের একমাত্র ক্ষেত্র। অথচ এখানকার সময়সীমা সম্পর্কে কারও কিছু জানা নেই। কাজেই আমাদের উচিত মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে গনিমত হিসেবে গ্রহণ করা। (তিরমিজি: ২৩০৮)। পরকালীন জীবনের জন্য সদা প্রস্তুত থাকা। সঙ্গে সঙ্গে পরকালের পথে যাত্রা এবং যাত্রাবিরতির জায়গা সম্পর্কে অবগত হওয়া।
কবরের জীবন: মানুষের পরকালের পথে যাত্রার প্রথম বিরতির জায়গা কবর। এখান থেকেই মানুষের পার্থিব জীবনের আমলের প্রতিদানস্বরূপ পুরস্কার অথবা তিরস্কার প্রাপ্তি আরম্ভ হয়। এখানে মুক্তি পেলে পরবর্তী সব স্তর সহজ হয়ে যায়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আখেরাতের মনজিলসমূহের মধ্যে কবর হলো প্রথম মনজিল। এখান থেকে কেউ মুক্তি পেয়ে গেলে তার জন্য পরবর্তী মনজিলগুলোতে মুক্তি পাওয়া সহজ হবে। আর এখান থেকে কেউ মুক্তি না পেলে পরবর্তী মনজিলগুলো তার জন্য আরও কঠিন হবে।’ (তিরমিজি: ২৩০৮)। মৃত্যুর পর এই কবর আমাদের বাড়ি (সুরা সোয়াদ, আয়াত: ৪৬)। যেখানে থাকতে হবে কেয়ামত পর্যন্ত। আর কেয়ামত কবে হবে, তা কারও জানা নেই। কাজেই এ দীর্ঘ অন্তরালবর্তী জীবন কীভাবে সুখময় করা যায়, সেই বিষয়ে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণকারী ব্যক্তিই প্রকৃত বুদ্ধিমান।
হাশরের ময়দান: মানুষের জীবনের যেমন শুরু-শেষ আছে, তেমনি পৃথিবীরও শুরু-শেষ আছে। মানুষের জীবনের শুরু জন্মের মাধ্যমে এবং শেষ মৃত্যুর মাধ্যমে। তেমনি পৃথিবীর শুরু সৃষ্টির মাধ্যমে এবং শেষ কেয়ামতের মাধ্যমে। কেয়ামতের পর মানুষ এবং পৃথিবী দুই-ই পুনরায় জন্ম ও সৃষ্টি হবে; যেমন প্রথমবার জন্ম ও সৃষ্টি হয়েছিল। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক বান্দা কেয়ামতের দিন ওই অবস্থায় পুনরুত্থিত হবে, যে অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করেছে।’ (মুসলিম: ২৮৭৮)। হাশরের ময়দানের প্রত্যেক মানুষ তার কর্ম অনুযায়ী আল্লাহর সামনে স্থান পাবে। হাশরের ময়দানে সময়ের ব্যাপ্তি হবে অনেক দীর্ঘ। জানা যায়, দুনিয়ার পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান হবে এক দিন। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তারপর সে (প্রত্যেক বান্দা) তার পথ দেখতে পাবে, হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে।’ (বোখারি: ১৪০২)। তাই সবার কর্তব্য, সেই ৫০ হাজার বছর দীর্ঘ দিবসের ভয় করা এবং সেখানে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
পুলসিরাতের পথ: হাশরের ময়দানে মানুষের পুরো জীবনের হিসাব হবে। হিসাব শেষে সামনে অগ্রসর হয়ে জান্নাত ও জাহান্নামের পথ। সে পথেই সবাইকে পাড়ি দিতে হবে এক দুর্গম সেতু, যাকে বলা হয় পুলসিরাত। নতুন আরেকটি মনজিলের সম্মুখীন হবে হাশরবাসী। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে সেখানে পৌঁছবে না। এটা তোমার পালনকর্তার অমোঘ সিদ্ধান্ত, অতঃপর আমরা মুত্তাকিদের মুক্তি দেব এবং সীমালঙ্ঘনকারীদের সেখানে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব।’ (সুরা মারয়াম : ৭১-৭২)। অর্থাৎ পাপী ব্যক্তি জাহান্নামের মধ্যে পড়ে যাবে, পাপ প্রায়শ্চিত্তের পর নাজাত পাবে। পক্ষান্তরে মুত্তাকি ব্যক্তি সহজে জাহান্নামের উপরিস্থিত সেতু অতিক্রম করার মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। (ইবনে মাজাহ: ৪২৮০)। এ পুল জাহান্নামের ওপরে স্থাপিত, যা বান্দার আমল অনুসারে সহজ অথবা কঠিন হবে। (ইবনে মাজাহ: ৪২৮১)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জাহান্নামের ওপর পুল স্থাপন করা হবে। যারা পুল পার হবে, আমি এবং আমার উম্মত তাদের মধ্যে প্রথম থাকব।’ (বোখারি: ৭৪৩৭)।
আরাফর প্রান্তর: জান্নাত এবং জাহান্নামের মধ্যবর্তী একটি জায়গার নাম আরাফ। পৃথিবীতে যেমন দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ থাকে, তেমনি পরকালে থাকবে আরাফ। আল্লাহ বলেন, ‘উভয় প্রকার মানুষের মধ্যখানে একটি অন্তরাল থাকবে। আরাফের ওপর অনেক মানুষ থাকবে। তারা প্রত্যেককে তার (উজ্জ্বল ও মলিন) চিহ্ন দেখে চিনে নেবে। তারা তখন জান্নাতিদের ডেকে বলবে, তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। তারা জান্নাতে প্রবেশ করেনি, কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষা করবে। আর যখন জাহান্নামবাসীদের দিকে তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তখন তারা (আরাফবাসীরা) বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের অত্যাচারী সম্প্রদায়ের সাথি করো না। আরাফবাসীরা যাদের চিহ্ন দেখে চিনবে, তাদের ডেকে বলবে, তোমাদের জনবল ও ঔদ্ধত্য তোমাদের কোনো কাজে আসল না। (জাহান্নামের উদ্ধত নেতারা দুর্বল আরাফবাসীদের প্রতি ইশারা করে বলবে) এরা কি তারাই, যাদের সম্পর্কে তোমরা কসম করে বলতে যে, এদের প্রতি আল্লাহ দয়া করবেন না। (সুরা আরাফ: ৪৬-৪৮)।
জাহান্নাম: আখেরাতের মনজিলসমূহের মধ্য সর্বাধিক ভয়াবহ মনজিল হলো জাহান্নাম। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই সেটা অত্যন্ত মন্দ আশ্রয়স্থল ও বসবাসের স্থান।’ (সুরা ফোরকান: ৬৬)। জাহান্নামের অধিবাসীদের সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই অপরাধীরা চিরকাল জাহান্নামের শাস্তির মধ্যে থাকবে।’ (সুরা জুখরুফ: ৭৪)। কাফের, মুশরিক, মুনাফিক ও পাপীদের এ জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। সেখানে তারা নানা ধরনের শাস্তি ভোগ করবে। যারা জাহান্নামি হবে, সেখানে তাদের মৃত্যু হবে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন জান্নাতবাসীদের বলা হবে, এ জীবন চিরন্তন, যার কোনো মৃত্যু নেই। জাহান্নামের অধিবাসীদের বলা হবে, হে জাহান্নামিরা! এ জীবন চিরন্তন, যার কোনো মৃত্যু নেই।’ (বোখারি: ৬৫৪৫)।
জান্নাত: জান্নাত হবে পৃথিবী থেকে বহুগুণ সুন্দর, শোভনীয় ও মোহময়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতে তোমাদের একটি ধনুকের ফলা বা একটি কদম পরিমাণ জায়গা দুনিয়া এবং দুনিয়ার ভেতর যা কিছু আছে সব থেকে অধিক উত্তম হবে। আর জান্নাতের অধিবাসী কোনো রমণী যদি পৃথিবীর দিকে একটু উঁকি দেয় তবে জান্নাত থেকে দুনিয়া পর্যন্ত স্থান আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে এবং তাদের সুবাস ছড়িয়ে পড়বে। তাদের পরনের ওড়নাও দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে উত্তম।’ (বোখারি: ৬১২১)। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘জান্নাতের কোনো জিনিস যদি এক চিমটি পরিমাণও পৃথিবীতে আনা হয়, তবে আসমান-জমিন ও সব স্থান আলোকিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে যাবে। জান্নাতবাসীদের কেউ যদি দুনিয়ায় একটু উঁকি দেয় এবং তার হাতের অলংকার প্রকাশ পায়, তাহলে তা সূর্যের আলোকে ম্লান করে দেবে, যেমন নক্ষত্রের আলোকে ম্লান করে দেয় সূর্য।’ (তিরমিজি: ২৫৩৮)।
লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ