পৃথিবীর মধ্যবিন্দুতে অবস্থিত সাগরবেষ্টিত এক বিশাল বালুভূমির নাম আরব। যার একপ্রান্তে ইয়েমেনের অ্যাডেন বন্দর, যেখান থেকে সাগর পেরোলেই আফ্রিকা। আরেকপ্রান্তে ওমানের মাসকট বন্দর, যেখান থেকে সাগর পেরোলেই ভারতবর্ষ। আরেকপ্রান্তে শামের ভূমধ্যসাগর এবং অন্যপ্রান্তে স্থলপথে পারস্যের সঙ্গে সংযুক্ত। তিন দিকে সাগর, একদিকে স্থল—এর মধ্যবর্তী মরু-আরব পৃথিবীর ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য ও অবিস্মরণীয় অংশ। এই আরব ভূমিরই মধ্যখানে অবস্থিত পবিত্র মক্কা নগরী, যা পৃথিবীর ইতিহাসের সূচনাকাল থেকে সংঘটিত অসংখ্য ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর প্রথম মানুষ হজরত আদম (আ.) এখানে নির্মাণ করেন পৃথিবীর প্রথম স্থাপনা পবিত্র কাবা। তার দুই হাজার বছর পর হজরত নুহ (আ.)-এর সময়ের মহাপ্লাবনে ধ্বংস হয়ে মাটিতে মিশে যায় এই ঘর। এর দুই হাজার বছর পর হজরত ইব্রাহিম (আ.) তার পুত্র ইসমাইলের সঙ্গে পুনরায় মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করেন কাবাঘরের ধ্বংসাবশেষ এবং তা পুনর্নির্মাণ করেন। হজরত ইসমাইল (আ.)-এর দুই হাজার বছর পর এ নগরীতেই জন্মগ্রহণ করেন তার উত্তরসূরি হজরত মুহাম্মদ (সা.)। হজরত ইসমাইল থেকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত দুই হাজার বছরের ইতিহাসকে এক শব্দে বলা হয় ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’। অন্যদিকে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর দ্বিতীয় পুত্রকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ফিলিস্তিনে বাইতুল মাকদিস এলাকায়। তার বংশধর ঘিরে দুই হাজার বছর ধরে রচিত হয় ‘বনি ইসরাইল’-এর ইতিহাস। এই পর্বে হজরত ইব্রাহিমের প্রথম পুত্র ইসমাইল ঘিরে রচিত আরবের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরছি।
হজরত ইব্রাহিমের ৮৬ বছর বয়সে তার ঔরসে এবং দ্বিতীয় স্ত্রী সারাহর গর্ভে জন্ম হয় প্রথম পুত্র ইসমাইলের। তখন আল্লাহর নির্দেশে হাজেরাকে নবজাতক পুত্র ইসমাইলসহ হিজাজ ভূমিতে নির্বাসিত করেন। হিজাজের ‘বাক্কা’ নামক জনমানবহীন এবং শষ্যহীন মরু উপত্যকায় পবিত্র কাবার পাশে রেখে আসেন। ওই সময় কাবাঘরের দৃশ্যমান কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সে স্থানটির আকার ছিল একটি উঁচু টিলার মতো। সেই টিলার উপরিভাগে বিশালাকৃতির একটি গাছ ছিল কেবল। ইব্রাহিম (আ.) স্ত্রী হাজেরা এবং শিশু পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে সেই বৃক্ষের নিচে রেখে শামে চলে যান। আল্লাহর অসীম কুদরতে সেখানে সৃষ্টি হয় জমজমের ফোয়ারা। পানির গন্ধে সেখানে আকাশে যাযাবর পাখির ওড়াউড়ি শুরু হয়। আকাশে পাখির আনাগোনা দেখে ইয়েমেন থেকে শাম অভিমুখে চলা একটি কাফেলা সেখানে হজরত হাজেরার অনুমতি নিয়ে তাঁবু ফেলে বসবাস শুরু করে। এভাবে গোড়াপত্তন হয় পবিত্র মক্কা নগরীর।
আরব জাতির বিকাশ তিন ধারায় বিন্যস্ত
এ নগরী ঘিরে যে আরব জাতির বিকাশ হয়, তাদের ইতিহাসবিদরা তিনটি ধারায় বিন্যস্ত করেন—১. আরব বায়িদা। এরা মূলত আদ, সামুদ, জুরহুম, হাজরামাউত ইত্যাদি বিভিন্ন গোত্রের দলছুট মানুষ। যারা প্রাণে বেঁচে আরবের বিভিন্ন জায়গায় বসতি স্থাপন করেছিল। কিন্তু তাদের বংশধারা সংরক্ষিত নেই। ২. আরবে আরিবা। এরা ইয়াশজুব ইবনে কাহতানের বংশধর। ইয়েমেন থেকে আগত। এদের কাহতানি আরবও বলা হয়। ৩. আরবে মুসতারিবা। এরা হজরত ইসমাইল (আ.)-এর বংশধর। এদের আদনানি আরবও বলা হয়। এই বংশেই শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। হজরত ইসমাইল (আ.) থেকে জন্ম হয় ১২ জন সন্তানের। তাদের থেকে মক্কা নগরীতে ১২টি গোত্রের সূত্রপাত হয়। ঠিক যেমন অন্যদিকে তার ভাই ইসহাকের পুত্র ইয়াকুব থেকে ফিলিস্তিনে বনি ইসরাইলের ১২টি গোত্রের সূত্রপাত হয়। হজরত ইসমাইলের ১২ পুত্রের সবাই মক্কা নগরীতে বসতি স্থাপন করেন। তাদের জীবনযাত্রা ছিল ইয়েমেন, মিশর, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এসব গোত্র ক্রমান্বয়ে আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং আরবের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে কালের আবর্তে অধিকাংশ গোত্রের পরিচয় মিশ্রিত হয়ে যায়। স্বচ্ছরূপে টিকে থাকে শুধু দুই পুত্র নাবিত এবং কায়দারের বংশধর। তাদের মাধ্যমে আরবের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় শিল্প ও সাহিত্যের সমৃদ্ধ ও বিস্ময়কর ভান্ডার।
আরবে বসবাসকারী জনসাধারণ ধর্মীয়ভাবে ছিল হজরত ইব্রাহিম (আ.) প্রবর্তিত এবং হজরত ইসমাইল (আ.) প্রতিষ্ঠিত ধর্মের অনুসারী। তাদের বলা হতো ‘হানিফ’। তারা এক আল্লাহতে বিশ্বাস করত, নবী ইসমাইল (আ.)-কে মেনে চলত এবং মূর্তিপূজা থেকে পবিত্র ছিল। মক্কায় কুরাইশ বংশের বনি হাশিম গোত্রের সদস্যরা ছিলেন এই ‘হানিফ’ ধারার অনুসারী। নবীজির স্ত্রী খাদিজা (রা.)-এর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নওফেলও এই ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তবে কালপ্রবাহে মক্কা ও আরবের অধিকাংশ মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়, নবী ইসমাইলের জীবন-দর্শন ভুলে এবং মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়ে যায়। ধার্মিকশ্রেণি হয়ে পড়ে সমাজের কোণঠাসা অংশ। আরবে মূর্তিপূজার প্রচলন শুরু হয় বনি খুজায়া গোত্রের সর্দার আমর ইবনে লুহাইয়ের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন আরবের একজন ধর্মপরায়ণ, দানশীল ও উদার ব্যক্তি। আরবের লোকজন তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাপোষণ করত। বরাবরের মতোই তিনি বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে শাম দেশ ভ্রমণে যান এবং সেখানে গিয়ে মূর্তিপূজার জমকালো আয়োজন দেখে মুগ্ধ হন। দেশে ফেরার সময় তিনি ‘হুবল’ নামক মূর্তি সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং পবিত্র কাবায় সেটি স্থাপন করে উপাসনা শুরু করেন। মক্কায় তার ভক্তবৃন্দও মূর্তি হুবলের উপাসনা করতে থাকে। এভাবে একত্ববাদের আরব ভূমিতে মূর্তিপূজার গোড়াপত্তন হয়ে যায়। হুবাল ছিল মানুষের আকৃতিতে তৈরি লাল আকিক পাথর নির্মিত মূর্তি। তার ডান হাত ভাঙা ছিল। কুরাইশরা সে ভাঙা হাতটি স্বর্ণ দিয়ে মেরামত করে। এটাই ছিল মুশরিকদের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত মূর্তি। ‘হুবাল’ ছাড়া আরবের প্রাচীনতম মূর্তিগুলোর মধ্যে ছিল ‘মানাত’ মূর্তি। এটি ছিল বনি হুজাইল ও বনি খুজায়া গোত্রের উপাস্য। লোহিত সাগরের তীরে কুদাইদ নামক ভূখণ্ডের সন্নিকটে মুসাল্লাল নামক স্থানে তা স্থাপিত ছিল। তারপর তায়েফবাসী উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে ‘লাত’ নাম মূর্তি। এটা ছিল বনি সাকিফ গোত্রের উপাস্য এবং তা তাফিয়ের মসজিদের বামপাশে মিনারের কাছে স্থাপিত ছিল। তারপর ‘জাতে-ইরক’-এর উচ্চভূমি শামের নাখলাহ নামক উপত্যকায় স্থাপিত হয় ‘উজ্জা’ নামক মূর্তি। এ মূর্তি ছিল কুরাইশ, বনি কিনানাহসহ অন্যান্য অনেক গোত্রের উপাস্য। এ তিনটি ছিল আরবের সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাত মূর্তি। তারপর হিজাজের বিভিন্ন অংশে শিরক ও মূর্তি পূজার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। ইরাকের নিকটবর্তী শামের অন্তর্গত দাওমাতুল জান্দালের জারাশ নামক স্থানে বনি কালব গোত্রে স্থাপিত হয় ‘ওয়াদ’ নামক মূর্তি। মক্কার নিকটবর্তী সাহিলের দিকে বনি হুজাইল ইবনে মুদরিকা গোত্রে স্থাপিত হয় ‘সুওয়া’ নামক মূর্তি। সাবার নিকটে জুরফ নামক স্থানে বনি গুতাইফের মুরাদ গোত্রে স্থাপিত হয় ‘ইয়াগুস’ নামক মূর্তি। ইয়েমেনের খাইওয়ান বসতির বনি হামদানে স্থাপিত হয় ‘ইয়াউক’ নামক মূর্তি। হিমইয়ার নামক স্থানে হিমইয়ারিদের অন্তর্গত আলে জুল কিলায় স্থাপিত হয় ‘নাসর’ নামক মূর্তি। এসব মূর্তির জন্য মন্দিরও নির্মাণ করা হয় আরবজুড়ে। প্রত্যেক গোত্র ও ঘরে ঘরে মূর্তি স্থান করে নেয়। এমনকি পবিত্র কাবাগৃহেও অসংখ্য মূর্তি ও প্রতিমায় ছেয়ে যায়। অবশেষে নবীজি (সা.) এসে মক্কা বিজয়ের সময় পবিত্র কাবায় স্থাপিত ৩৬০টি মূর্তি উচ্ছেদ করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। অন্যসব মূর্তিকেও অপসারণ করা হয়।
প্রতিকূল পরিবেশে সংঘবদ্ধ জীবনযাত্রা
মরু আরবের প্রতিকূল পরিবেশে মানুষের জীবনযাত্রা ছিল সংঘবদ্ধ। সবাই গোত্রপ্রধানকে মেনে চলত। এ কারণে বংশধারা সংরক্ষণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক, রক্তের মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়কে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো। মানসম্মান ও ন্যায়-অন্যায় সবকিছু নির্ণয় হতো গোত্রীয় স্বার্থের নিরিখে। নিজ গোত্রের কেউ সামান্য আহত ও অপমানিত হলেও কঠিন প্রতিশোধ নেওয়া হতো। এর সূত্র ধরে গোত্রে গোত্রে যুগ যুগ ধরে চলত যুদ্ধবিগ্রহ। সে কারণ তারা অধিক সংখ্যায় পুত্রসন্তান কামনা করত, অধিক পুত্রের পিতাকে সবাই সমীহ করত। যুদ্ধে পরাজিত হলে অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে নারীদের লুট করে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে অথবা দারিদ্র্যের কারণে অনেকে তাদের কন্যাসন্তানকে শিশুকালেই হত্যা করে ফেলত। তবে আরবে প্রচলিত ধর্মীয় প্রথা মেনে সবাই বছরে চারটি সম্মানিত মাসে (জিলকদ, জিলহজ, মুহাররম ও রজব) যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ রাখত। এ সময়ে গোত্রনেতারা একত্রে বসে সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা, কোনো গোত্রের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু বা শেষ করা কিংবা সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার অবকাশ পেতেন। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে আসা হাজিদের সেবা সবাই একসঙ্গেই আত্মনিয়োগ করতেন। আরবের জমিন অনুর্বর হওয়ায় তাদের প্রধান জীবিকা মাধ্যম ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। তায়েফ, সিরিয়া, ইয়েমেন প্রভৃতি উর্বর ও উন্নত এলাকা ছাড়াও সর্বত্র পশু-পালন ছিল অন্যতম অবলম্বন। উট ছিল বিশেষ করে দূরপাল্লার সফরের জন্য একমাত্র স্থল পরিবহন। গাধা, খচ্চর ব্যবহৃত হতো স্থানীয় পরিবহনের কাজে। ঘোড়া ছিল যুদ্ধের বাহন। মক্কার ব্যবসায়ীরা শীতকালে ইয়েমেনে এবং গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায় দূরপাল্লার ব্যবসায়িক সফর করত। আর্থিক লেনদেনে সুদের প্রচলন ছিল। তারা চক্রবৃদ্ধি হারে পরস্পরকে সুদভিত্তিক ঋণ দিত। রাস্তাঘাটে প্রায়ই ব্যবসায়ী কাফেলা লুট হতো। সেজন্য সশস্ত্র যোদ্ধাদল নিয়ে তারা রওনা হতো। তবে কাবাগৃহের সেবক হওয়ার সুবাদে মক্কার ব্যবসায়ী কাফেলা বিশেষভাবে সম্মানিত ছিল এবং সর্বত্র নিরাপদ থাকত। বছরের আট মাস লুটতরাজের ভয় থাকলেও পবিত্র চার মাসে তারা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করত। এ সময় ওকাজ, জুল-মাজাজ, জুল-মাজান্নাহ প্রভৃতি বড় বড় বাজারে বাণিজ্য মেলা ছাড়াও আরবের বিভিন্ন প্রান্তে আরও অনেক বড় বড় মেলা বসত। এসব বাণিজ্য মেলায় প্রচুর বেচাকেনার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা লাভবান হতো। তাদের মধ্যে বস্ত্র, চর্ম ও ধাতব শিল্পের প্রচলন ছিল। ইয়েমেন, হীরা, সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল এসব শিল্পে সমৃদ্ধ ছিল। আরবের নারীরা গৃহের আঙিনায় বসে সুতা কাটার কাজে নিয়োজিত থাকত। কোনো কোনো এলাকায় কৃষিকাজ হতো। ছোলা, ভুট্টা, যব ও আঙুরের চাষ হতো। খেজুর ছিল আরবদের অন্যতম প্রধান উপজীবিকা।
মরুভূমির মুক্ত-স্বাধীন ও সাহসী জীবন
আদিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমিতে আরবদের জীবন ছিল মুক্ত-স্বাধীন, সাহসী ও উচ্ছল। পৃথিবীতে যেমন আছে রাত-দিন, অন্ধকার ও আলো; তেমনি আরবদের মধ্যেও ছিল ভালো ও মন্দের মিশ্রণ। আরবদের মধ্যে যেমন ছিল মদ্যপান, ব্যভিচার, মারামারি, হানাহানি এবং নানাবিধ পাপাচার; ঠিক তেমনি তাদের মধ্যে ছিল উদারতা, সততা, পৌরুষ, সৎসাহস, ব্যক্তিত্ববোধ, অনাড়ম্বরতা, দানশীলতা, আমানতদারী, মেহমানদারী, প্রতিজ্ঞাপরায়ণতা ইত্যাদি অসংখ্য সৎগুণের সমাবেশ। তাদের মধ্যে দুঃসাহসিকতা ও বেপরোয়া ভাবটা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। তাদের সৎসাহস, আমানতদারী, সত্যবাদিতা, কাব্য প্রতিভা, স্মৃতিশক্তি, অতিথিপরায়ণতা ছিল কিংবদন্তির মতো। তাদের কাব্যপ্রিয়তা এবং উন্নত কাব্যালংকারের আধুনিক যুগেও উপমাতুল্য। তাদের স্মৃতিশক্তি এত প্রখর ছিল যে, একবার শুনলেই হুবহু মুখস্থ বলে দিত। বড় বড় কাসিদা বা দীর্ঘ কবিতা তাদের মুখে মুখেই চালু ছিল। এজন্য লেখালেখি চর্চাকে তারা মনে করত মেধাশক্তির দুর্বলতার আলামত। দুর্বল স্মৃতির কারণে বর্তমানে লেখাকেই অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ লেখায়ও ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তৎকালীন আরবদের স্মৃতিতে ভুল হতো খুবই কম। সম্ভবত এসব সদগুণাবলির কারণেই বিশ্বনবীকে আল্লাহ মক্কাতে প্রেরণ করেন। যাদের প্রখর স্মৃতিতে কোরআন ও হাদিস অবিকৃত অবস্থায় নিরাপদ থাকে এবং পরবর্তীকালে তা লিখিত আকারে সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়। যদিও কোরআন-হাদিস লিখিতভাবেও তখন সংকলিত হয়েছিল। মোট কথা, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল আরব ভূখণ্ডের মরুচারী মানুষের মধ্যে বিভিন্ন দুর্বলতা থাকলেও তাদের মধ্যে ছিল অনেক উন্নত মানবিক গুণাবলি। কালের করালগ্রাসে তারা কিছু ভালো গুণ ভুলে গিয়েছিল। এ ভুলে যাওয়াকে আরবিতে বলা হয় ‘জাহালাত’ বা অজ্ঞতা। তারা যে সময়কালটিতে এমন জাহেলি বা অজ্ঞতাপূর্ণ অবস্থায় কাটিয়েছে, সেই সময়কালটিকে বলা হয় ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা অজ্ঞতাপূর্ণ সময়কাল। অবশেষে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এসে সেই জাহেলিয়াতের অন্ধকার দূর করেন ইলমের আলো দ্বারা। হেরা পর্বতে ধ্যানরত অবস্থায় নবীজির ওপর পবিত্র কোরআনের প্রথম যে প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়, সেটা ছিল ‘পাঠ করো’ এ আদেশ। কলমের দ্বারা লিখিত ইলম পাঠ করার নির্দেশের মাধ্যমেই শুরু হয় পৃথিবীর মানুষকে জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতার আঁধার থেকে ইসলামের আলোয় ফেরানোর মিশন। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম-হাওয়া যে আরবের আরাফাতের ময়দানে প্রথম মিলিত হন, হজরত আদম যে মক্কা নগরীতে প্রথম মানবতার প্রতীক স্থাপন করেন, সেই মক্কা নগরীতেই প্রেরিত হন পৃথিবীর শেষ সময়ের আসমানি বার্তাবাহক হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং সেখানেই অবতীর্ণ হয় পৃথিবীর মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার শেষ বার্তা পবিত্র কোরআন।
লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ