শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১১ এএম
আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের ঘটনাপ্রবাহ

ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের ঘটনাপ্রবাহ

পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তার ইবাদতের জন্য। প্রথম মানুষ হজরত আদম (আ.) থেকে যুগে যুগে সব নবীর মাধ্যমে মানবজাতিকে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু সর্বদাই শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ আল্লাহকে ভুলে স্বকৃত প্রতিমার উপাসনায় মনোনিবেশ করেছে। মানুষ যখন আল্লাহকে ভুলে পাপের পথে ধাবিত হয়েছে, নবীর মাধ্যমে সতর্ক করার পরও মানুষ সচেতন হয়নি, তখন আসমানি আজাবের মাধ্যমে তাদের ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে পতন হয়েছে অনেক জাতি ও সভ্যতার। হজরত নুহ (আ.)-এর সময়ের মহাপ্লাবনের পর পুনরায় পৃথিবী আবাদ হয় মানুষের দ্বারা। গড়ে ওঠে নতুন নতুন সভ্যতা। মহাপ্লাবনের পর প্রথম যে সুরক্ষিত নগর গড়ে ওঠে, সেটা ইয়েমেনের সানা। সেখান থেকে তৈরি হয় হিময়ারি বা সুমেরি সভ্যতা। কিন্তু একসময় পতন ঘটে সুমেরি সভ্যতার। তারপর ইরাকের ফুরাত নদীর তীরে বসরার কাছে গড়ে ওঠে ব্যাবিলন শহর। সেখানে গোড়াপত্তন হয় ক্যালিডীয় সভ্যতার। তাদের মধ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক চর্চা হয়। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে মূর্তি পূজা। হজরত নুহ (আ.)-এর দুই হাজার বছর পর সেখানে মানুষকে মূর্তি পূজা থেকে আল্লাহর দিকে ফেরানোর দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে। তিনি ছিলেন হজরত নুহ (আ.)-এর এগারতম অধস্তন পুরুষ। হজরত ইব্রাহিম (আ.) মূর্তি পূজার বিরোধিতা করেন এবং এক আল্লাহর দিকে মানুষকে ফিরে আসতে বলেন। তিনিই ‘ইসলাম’ ও ‘মুসলিম’ শব্দের প্রবর্তন করেন এবং তার দুই পুত্র থেকে পরবর্তী দুই হাজার বছর উৎসারিত হয় দুই ধর্মবংশ। বড় পুত্র ইসমাইল (আ.) মক্কায় বসবাস করেন এবং তার বংশধর থেকে দুই হাজার বছর মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। অন্যদিকে দ্বিতীয় পুত্র ইসহাক বসবাস করেন ফিলিস্তিনে এবং তার পুত্র ইয়াকুব (আ.) থেকে উৎপত্তি হয় বনি ইসরাইল জাতির। দুই হাজার বছরের ইতিহাসে এই বংশে জন্মগ্রহণ করেন অসংখ্য নবী ও রাসুল; যেমন ইউসুফ (আ.), মুসা ও হারুন (আ.), দাউদ ও সুলাইমান (আ.) এবং সর্বশেষ ঈসা (আ.)।

ইরাকের ব্যাবিলন শহরে তখন বসবাস করত ক্যালিডীয় জাতি। শিক্ষা ও সভ্যতায় তারা ছিল শীর্ষস্থানীয়। সৌরজগৎ নিয়েও তারা গবেষণা করত। ব্যাবিলনেই পরে নির্মিত হয় পৃথিবীর আশ্চর্য ঝুলন্ত উদ্যান। তাদের একচ্ছত্র সম্রাটের নাম ছিল নমরুদ। একটি মতে, নমরুদ ছিল সম্রাটের উপাধি। প্রায় ৪০০ বছর ধরে শাসন পরিচালনা করছিলেন নমরুদ। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শক্তির অহংকারে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিল ক্যালিডীয় লোকজন। শক্তির অহংকারে উদ্ধত হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন নমরুদ। একপর্যায়ে নিজেকে ‘উপাস্য’ হওয়ার দাবি করেন তিনি। জনগণও লিপ্ত ছিল বিভিন্ন মূর্তি ও তারকার পূজায়। মহান আল্লাহ এ খোদা দাবিদার নমরুদের বিশ্বস্ত মন্ত্রী ও প্রধান পুরোহিত ‘আজর’-এর ঘরেই জন্মদান করান মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে। নবুয়ত লাভ করে তিনি তার বাবা ও জাতিকে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে আহ্বান করেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘কিতাবে ইব্রাহিমের বৃত্তান্ত আলোচনা করুন। নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ নবী। স্মরণ করুন, যখন তিনি তার পিতাকে বলেছিলেন, হে আমার বাবা! কেন আপনি এমন জিনিসের ইবাদত করেন, যা কিছুই শোনে না, কিছুই দেখে না এবং আপনার কোনো কাজও করতে পারে না? হে আমার বাবা! আমার কাছে এমন এক জ্ঞান এসেছে, যা আপনার কাছে আসেনি। আপনি আমার কথা শুনুন, আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাব। হে আমার বাবা! আপনি শয়তানের ইবাদত করবেন না। শয়তান তো চিরদয়াময় আল্লাহর অবাধ্যতাকারী।’ (সুরা মারয়াম, আয়াত: ৪১-৪৫)। আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘হে নবী! আপনি তাদের শোনান ইব্রাহিমের বৃত্তান্ত। যখন তিনি তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বললেন, আপনারা কীসের ইবাদত করেন? তারা বলল, আমরা প্রতিমাদের ইবাদত করি এবং তাদেরই সামনেই নিষ্ঠার সঙ্গে পড়ে থাকি। ইব্রাহিম বললেন, আপনারা যখন তাদের ডাকেন, তখন তারা কি আপনাদের কথা শোনে? কিংবা তারা কি আপনাদের কোনো উপকার বা ক্ষতি করতে পারে? তারা বলল, আসল কথা হচ্ছে, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের এমনই করতে দেখেছি। ইব্রাহিম বললেন, আপনারা কি কখনো গভীরভাবে ভেবে দেখেছেন, আপনারা কীসের ইবাদত করছেন? আপনারা আপনাদের পূর্ববর্তী পূর্বপুরুষরা? এসব তো আমার শত্রু; এক রাব্বুল আলামিন ছাড়া, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে সঠিক পথ দেখান। তিনি আমাকে খাওয়ান ও পান করান। আমি যখন অসুস্থ হই, তিনি আমাকে সুস্থ করেন। তিনিই আমাকে মৃত্যু দেবেন এবং পুনরায় জীবিত করবেন। (সুরা শুয়ারা, আয়াত: ৬৯-৮২)

পরিবার ও সমাজের সামনে ইব্রাহিম (আ.) অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ভাষায় আল্লাহর একত্ববাদ ও প্রতিমার অসারতা তুলে ধরেন। তবে মানুষ যখন কোনো একটি মতাদর্শকে অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরে, তখন সহজ কথাও বোধগম্য হয় না। তাই ইব্রাহিম (আ.) ভাবলেন, এমন কিছু একটা করা দরকার, যাতে পুরো সমাজের মানুষের মধ্যে সঠিক বোধ জাগ্রত হয় এবং তাওহিদি চেতনার উন্মেষ ঘটে। তিনি তার সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় দেবমন্দিরে গিয়ে মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলার ইচ্ছা করলেন। ইব্রাহিম (আ.)-এর সম্প্রদায় বছরের একটা বিশেষ দিনে উৎসব পালন করত। বরাবরের মতোই কওমের লোকেরা তাকে ওই মেলায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু তিনি অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে সেখানে যেতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। তিনি ভাবলেন, আজকের এ সুযোগে ওদের দেবমন্দিরের মূর্তিগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া যায়। যাতে ওরা ফিরে এসে ওদের মিথ্যা উপাস্যদের অসহায়ত্বের বাস্তব দৃশ্য দেখতে পায়। যথারীতি তিনি দেবালয়ে ঢুকে পড়লেন এবং দেব-দেবীদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমাদের সামনে এত ভোগ-নৈবেদ্যের সমাহার। তিনি বললেন, ‘তোমরা এসব খাচ্ছ না কেন? কী ব্যাপার তোমরা কথা বলছ না কেন? তারপর তিনি ডান হাতে রাখা (সম্ভবত কুড়াল দিয়ে) ভীষণ জোরে আঘাত করে সবগুলোকে গুঁড়িয়ে দিলেন।’ (সুরা সাফফাত: ৯১-৯৩)। তবে বড় মূর্তিটা পূর্বাবস্থায় রেখে দিলেন, যাতে লোকেরা তার কাছে ফিরে যায়।’ (সুরা আম্বিয়া: ২১/৫৮)। মেলা শেষে লোকজন ফিরে এলো এবং যথারীতি দেবমন্দিরে গিয়ে প্রতিমাগুলোর অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গেল এবং তারা বলাবলি করতে লাগল, এটা নিশ্চয়ই ইব্রাহিমের কাজ। কেননা তাকেই আমরা সবসময় মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে বলতে শুনি। অতঃপর ইব্রাহিমকে সেখানে ডেকে আনা হলো এবং জিজ্ঞেস করল, হে ইব্রাহিম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যদের সঙ্গে এরূপ আচরণ করেছ? ইব্রাহিম বললেন, এ কাজ তো করেছে এই বড় মূর্তিটা; এদের জিজ্ঞেস করেই দেখো, যদি তারা কথা বলতে পারে! সম্প্রদায়ের নেতারা এ কথা শুনে লজ্জা পেল এবং মাথা নিচু করে বলল, ‘তুমি তো জানো যে, এরা কথা বলে না। তখন তিনি বললেন, তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত করো, যা তোমাদের উপকারও করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না? তোমরা এমন বস্তুর পূজা করো, যা তোমরা নিজ হাতে তৈরি করো? অথচ আল্লাহ তোমাদের ও তোমাদের কর্মসমূহকে সৃষ্টি করেছেন? আফসোস, তোমাদের জন্য এবং আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদের পূজা করো, ওদের জন্য। তোমরা কি কিছুই বোঝো না? (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৬২-৬৭)।

দেশের ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসবে এত বড় ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল। নমরুদের রাজদরবারে ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হলো। ইব্রাহিম (আ.)-কে চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করা হলো। সিদ্ধান্ত হলো, তাকে আর বাঁচতে দেওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে মারতে হবে, যেন কেউ তার দলে যেতে সাহস না করে। তারা তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার প্রস্তাব গ্রহণ করল এবং সেটা বাদশাহ নমরুদের কাছে পেশ করল। সম্রাটের মন্ত্রী ও দেশের প্রধান পুরোহিতের ছেলে ইব্রাহিম। অতএব তাকে সরাসরি সম্রাটের দরবারে আনা হলো। নমরুদ ৪০০ বছর ধরে রাজত্ব করায় উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে উঠেছিল এবং নিজেকে একমাত্র উপাস্য ভেবেছিল। তাই সে ইব্রাহিমকে জিজ্ঞেস করল, বলো তোমার উপাস্য কে? নমরুদ ভেবেছিল, ইব্রাহিম তাকেই উপাস্য বলে স্বীকার করবে। কিন্তু নির্ভীক কণ্ঠে ইব্রাহিম (আ.) জবাব দিলেন, ‘আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি মানুষকে বাঁচান ও মারেন।’ নমরুদ বলল, ‘বরং আমিও বাঁচাই ও মারি।’ অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে খালাস দিয়ে মানুষকে বাঁচাতে পারি। আবার খালাসের আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারি। এভাবে সে নিজেকেই মানুষের বাঁচা-মরার মালিক হিসেবে সাব্যস্ত করল। ইব্রাহিম তখন দ্বিতীয় যুক্তি পেশ করে বললেন, ‘আমার আল্লাহ সূর্যকে পূর্বদিক থেকে উদিত করেন, আপনি তাকে পশ্চিম দিক হতে উদিত করুন।’ এতে নমরুদ লা-জবাব হয়ে যায়। (সুরা বাকারা: ২৫৮)। রাজা-প্রজা সবাই জবাব খুঁজে না পেয়ে অহংকারে ফেটে পড়ে। নমরুদ ইব্রাহিম (আ.)-কে জ্বলন্ত আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নির্দেশ জারি করল। কোরআনে বর্ণিত হয়ছে, ‘তারা ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে মহাফন্দি আঁটতে চাইল। অতঃপর আমি তাদেরই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম।’ (সুরা আম্বিয়া: ৭০)। আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘একটা ভিত নির্মাণ করা হলো এবং সেখানে বিরাট অগ্নিকুণ্ড তৈরি করা হলো। তারপর সেখানে তাকে নিক্ষেপ করা হলো।’ (সুরা সাফফাত: ৯৭)। তখন আল্লাহর নির্দেশ এলো, ‘হে আগুন! ঠান্ডা হয়ে যাও এবং ইব্রাহিমের জন্য শান্তিদায়ক হয়ে যাও।’ (সুরা আম্বিয়া: ৬৯)। আল্লাহর কুদরতে ইব্রাহিম (আ.) জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে জীবন্ত বের হয়ে আসলেন।

হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর বয়স তখন ৭০ ছাড়িয়েছে। জন্মভূমি ব্যাবিলনে তার টিকে থাকা দুষ্কর হয়ে উঠল। আল্লাহর নির্দেশে তিনি হিজরতের সিদ্ধান্ত নেন। দীর্ঘ দাওয়াতি জীবনে তার স্ত্রী সারা এবং ভাতিজা লুত ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তাদের নিয়ে তিনি ইরাক ছেড়ে শাম অভিমুখে হিজরত করেন। বাইতুল মাকদিসের নিকটবর্তী কেনানে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তবে কিছুদিন পরই সেখানে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। মানুষ সব দলে দলে ছুটতে থাকে মিশরের দিকে। মিশর তখন ফেরাউনদের শাসনাধীনে ছিল। উল্লেখ্য, মিশরের শাসকদের উপাধি ছিল ‘ফেরাউন’। তৎকালীন মিশরের ফেরাউন ছিল একজন মদ্যপ ও নারীলোভী শাসক। তার নিয়োজিত লোকেরা পথে কোনো সুন্দরী নারী পেলেই তাকে ধরে নিয়ে বাদশাহর কাছে পৌঁছে দিত। ইব্রাহিম (আ.)-এর স্ত্রী সারাকে ফেরাউনের লোকজন অপহরণ করে নিয়ে গেলে ইব্রাহিম (আ.) নামাজে দাঁড়িয়ে যান এবং আল্লাহর কাছে আকুল কণ্ঠে দোয়া করেন। আল্লাহ দোয়া কবুল করেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘সারাকে যখন সম্রাটের কাছে নেওয়া হয় এবং সম্রাট তার দিকে এগিয়ে যায়, তখন তিনি অজু করার জন্য গেলেন এবং নামাজে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! যদি তুমি জেনে থাকো যে, আমি তোমার ওপর ও তোমার রাসুলের ওপর ইমান এনেছি এবং আমি আমার একমাত্র স্বামীর জন্য সতীত্ব বজায় রেখেছি, তাহলে তুমি আমার ওপর এ কাফেরকে বিজয়ী করো না।’ (বোখারি, হাদিস: ২২১৭)। দোয়া কবুল হয়ে যায়। সম্রাট এগিয়ে যেতেই তার হাত-পা অবশ হয়ে পড়ে গিয়ে গোঙাতে থাকে। তখন সারা প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! লোকটি যদি এভাবে মারা যায়, তাহলে লোকেরা ভাববে আমি ওকে হত্যা করেছি।’ তখন আল্লাহ সম্রাটকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু শয়তান আবার এগিয়ে যেতে চাইল। তাতে ব্যর্থ হয়ে আবার মড়ার মতো পড়ে রইল। এভাবে কয়েকবার বেহুঁশ হয়ে পড়ল আর সারার দোয়ায় বাঁচল। অবশেষে সে বলল, তোমরা আমার কাছে একটা শয়তানীকে পাঠিয়েছ। যাও একে ইব্রাহিমের কাছে ফেরত দিয়ে আসো এবং এর খেদমতের জন্য হাজেরাকে দিয়ে দাও। অতঃপর সারা তার খাদেমা হাজেরাকে নিয়ে সসম্মানে স্বামী ইব্রাহিমের কাছে ফিরে এলেন। এ ঘটনার পর ইব্রাহিম (আ.) পুনরায় মিশর থেকে কেনানে ফিরে যান। বন্ধ্যা স্ত্রী সারা তার খাদেমা হাজেরাকে স্বামী ইব্রাহিমকে উপহার দেন এবং স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে বলেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর বয়স তখন ৮৬। সেই বয়সে দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন তার প্রথম সন্তান ইসমাইল (আ.)। আসলে ইসমাইল ছিলেন নিঃসন্তান ইব্রাহিম (আ.)-এর দোয়ার ফসল। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি সৎকর্মশীল সন্তান দাও। অতঃপর আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।’ (সুরা সাফফাত: ১০০-১০১)।

তবে বছরখানেক পরই আল্লাহর নির্দেশে দ্বিতীয় হাজেরা এবং প্রথম সন্তান ইসমাইলকে মক্কার মরুভূমিতে রেখে আসতে হয়। মাত্র এক থলে খেজুর ও এক মশক পানিসহ তাদের মক্কায় রেখে আসেন। তখন হাজেরা জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কি আল্লাহর হুকুমে আমাদের এভাবে ফেলে যাচ্ছেন?’ ইব্রাহিম (আ.) ইশারায় বললেন, ‘হ্যাঁ’। তখন হাজেরা বলেন, ‘তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না।’ কয়েক দিনের মধ্যেই খেজুর ও পানি ফুরিয়ে যায়। মা হাজেরা খাবারের সন্ধানে সাফা-মারওয়া পাহাড় চক্কর দিতে থাকেন। তখন ফেরেশতা জিবরাইলের পাখার আঘাতে শিশু ইসমাইলের পায়ের কাছে পানির ফোয়ারা সৃষ্টি হয়। পানির ঘ্রাণে আকাশে পাখির আনাগোনা শুরু হয়। এ দৃশ্য দেখে ইয়েমেন থেকে শামগামী একটি যাযাবর গোষ্ঠী সেখানে বসতি স্থাপন করে। এভাবে গোড়াপত্তন হয় পবিত্র মক্কা নগরীর। আল্লাহর পক্ষ থেকে ইব্রাহিম (আ.)-কে নির্দেশ দেওয়া হয় মক্কায় চাপা পড়ে থাকা কাবাঘর পুনর্নির্মাণের। বালক পুত্র ইসমাইলকে নিয়ে তিনি কাবাঘর নতুন করে নির্মাণ করেন। তখন ইব্রাহিম (আ.) দোয়া করেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! এ শহরকে আপনি শান্তিময় করে দিন এবং আমাকে ও আমার সন্তান-সন্ততিকে মূর্তি পূজা থেকে দূরে রাখুন।’ (সুরা ইব্রাহিম: ৩৫)। পিতা-পুত্র মিলে আরও দোয়া করেন, ‘হে আমাদের প্রভু! আপনি আমাদের এই খেদমত কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। হে প্রভু! আপনি আমাদের উভয়কে আপনার আজ্ঞাবহে পরিণত করুন এবং আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকেও আপনার প্রতি একটা অনুগত দল সৃষ্টি করুন। হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি তাদের মধ্য থেকেই তাদের নিকটে একজন রাসুল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের নিকটে এসে আপনার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনাবেন, তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী ও দূরদৃষ্টিময়।’ (সুরা বাকারা: ১২৭-১২৯)। এ ঘটনা ও দোয়ার প্রায় দুই হাজার বছর পর মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি বলতেন, ‘আমি আমার পিতা ইব্রাহিমের দোয়ার ফসল ও ঈসার সুসংবাদ।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান: ১৫৪৫)।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১০

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১১

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১২

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৩

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৪

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৫

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৬

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৭

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

১৮

‘এক ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে আরেক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’

১৯

জুলাই বিপ্লবে আহত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বাবুকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ড

২০
X