২০০৯ সালে যেখানে বাংলাদেশের জনপ্রতি কোনো জলবায়ু ঋণ ছিল না, সেখানে ২০২২ সালে জনপ্রতি মোট জলবায়ু ঋণ ৭৯.৬১ ডলার বা ৯ হাজার ৪৮৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ঋণভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়নের ওপর নির্ভরতার ঝুঁকি তুলে ধরা হয়, যা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোকে ঋণের বোঝা চাপিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করবে
শিল্পোন্নত দেশগুলো ২০২১-২২ অর্থবছরে গড়ে প্রায় ১.২৭ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল প্রদানের দাবি করলেও বাস্তবে মাত্র অনুদান ছিল মাত্র ৫ শতাংশ (৬৩ বিলিয়ন ডলার) এবং অভিযোজন বাবদ অর্থায়নের পরিমাণ মাত্র ৫.৪৩ শতাংশ (৬৯ বিলিয়ন ডলার), যা স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাৎসরিক প্রয়োজনের তুলনায় খুবই স্বল্প (ক্লাইমেট পলিসি ইনস্টিটিউট, ২০২৩)। উল্লেখ্য, আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিতব্য ২৯তম বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২৫ সাল থেকে বছরে কম্পক্ষে ১ ট্রিলিয়ন ডলার অনুদানভিত্তিক জলবায়ু তহবিলের চাহিদার প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে অনুদানের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য রেয়াতি ঋণের সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে ২০০৯ সালে জলবায়ু অর্থায়নের সংজ্ঞা গৃহীত হলেও জলবায়ু অর্থায়নের সর্বজনীন সংজ্ঞা এখনো গৃহীত হয়নি, তবে জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (UNFCCC) জলবায়ু অর্থায়ন বলতে যে তহবিল জিএইচজি নির্গমন হ্রাস করার প্রশমন পদক্ষেপের পাশাপাশি জলবায়ু অভিযোজন এবং রেজিলিয়েন্স নিশ্চিতে সরকারি ও বেসরকারি তহবিল ব্যবহার করাকে বোঝায়। জলবায়ু অর্থায়নের আইনি বাধ্যতা না থাকায় ক্রমেই এটা শিল্পোন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা সর্বজনবিদিত যে, শিল্পোন্নত দেশগুলো ২০২৩ সালে ২.৪৪৩ ট্রিলিয়ন ডলার সামরিক ব্যয় করছে, জলপাই বাগানসমৃদ্ধ গাজার মানুষ এবং প্রকৃতি ধ্বংসে এরই মধ্যে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার যুদ্ধ সহায়তা পেয়েছে ইসরায়েল।
তবে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চ্যানেলে সমন্বয় ছাড়াই তহবিল প্রদানের কারণে ট্র্যাকিং চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে, যা স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। যদিও কিছু বিশেষজ্ঞ জলবায়ু ঋণকে বৈশ্বিক নির্গমন-সম্পর্কিত ক্ষতির ব্যয় হিসেবে উল্লেখ করেন চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ পরিচালিত ‘জলবায়ু অর্থায়নে ন্যায়বিচার ও সমতা: বাংলাদেশ এবং অন্যান্য এলডিসির জন্য জলবায়ু ঋণের ফাঁদের ঝুঁকি’ শীর্ষক গবেষণায় জলবায়ু ঋণ বলতে অভিযোজন এবং প্রশমন কার্যক্রম উভয়ের জন্য দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উৎস থেকে জলবায়ু-সম্পর্কিত ঋণ প্রদানের ফলে জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ঋণভিত্তিক জলবায়ু কার্যক্রমের সম্ভাব্য আর্থিক চাপকে বোঝানো হয়েছে।
বাংলাদেশ এবং অন্যান্য অনুন্নত দেশ (এলডিসি) জলবায়ু ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে যেখানে বাংলাদেশের জনপ্রতি কোনো জলবায়ু ঋণ ছিল না, সেখানে ২০২২ সালে জনপ্রতি মোট জলবায়ু ঋণ ৭৯.৬১ ডলার বা ৯ হাজার ৪৮৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ঋণভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়নের ওপর নির্ভরতার ঝুঁকি তুলে ধরা হয়, যা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোকে ঋণের বোঝা চাপিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করবে। এ প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতি ১ ডলার অনুদানের বিপরীতে ৫৩ সেন্ট বা অর্ধেকের বেশি ঋণ হিসেবে গ্রহণ করেছে, জিডিপির হিসাবে প্রতি ১০০ মার্কিন ডলারের বিপরীতে একটি দেশ ৩ সেন্ট জলবায়ু ঋণের ভারে পড়েছে। ২০০২-২০২১ সময়কালে মাথাপিছু জলবায়ু ঋণের সার্বিক ভার দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য প্রায় ৮০ ডলার, অর্থাৎ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২০০৯ সালের আগে প্রায় শূন্য ছিল। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের হিসাবে প্রতি ১ মার্কিন ডলার জলবায়ু ঋণের জন্য ০.০৮ মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। শুধু তাই নয়, ঋণভারে জর্জরিত জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের জনগণের প্রতিজনের ওপর যথাক্রমে প্রায় ৪২ ডলার, ৬৪.৩ ডলার এবং ১৫ ডলার করে জলবায়ু ঋণের দায়ভার পড়েছে। আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত মোজাম্বিকের মানুষকেও গড়ে প্রতিজনকে প্রায় ১৪ ডলার প্রদান জলবায়ু ঋণের চাপ বইতে হবে সামনের দিনগুলোতে।
জলবায়ু দুর্বলতা, দারিদ্র্যের অবস্থা এবং বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ক্রেডিট রেটিং পারফরম্যান্সের সঙ্গে জলবায়ু ঋণের বোঝার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, যেখানে জলবায়ুর বোঝা যথেষ্ট এবং অনেক নাগরিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মুখোমুখি। ভুটানের ক্লাইমেট ঝুঁকি সূচক (সিআরআই) স্কোর ১১৮, যা উচ্চ জলবায়ু দুর্বলতা নির্দেশ করে, মাথাপিছু জলবায়ুর বোঝা প্রায় ৪২ ডলার এবং প্রায় ১০ শতাংশ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। এর বিপরীতে, বাংলাদেশের সিআরআই ২৮.৩৩-এর কম কিন্তু মাথাপিছু জলবায়ু ঋণের বোঝা উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ ভুটানের তুলনায় দ্বিগুণ এবং প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ে গত স্বৈরাচারী সরকার প্রায় ৩ হাজার ডলার ঋণের পাশাপাশি অতিরিক্ত প্রায় ৮০ ডলার জলবায়ু ঋণের দায় চাপিয়েছে, যা নির্দেশ করছে বাংলাদেশের জন্য ঋণের ফাঁদে পড়ার উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলো মাত্র ৩.৩ শতাংশ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ করলেও প্রতি ১ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের বিপরীতে প্রতি নাগরিক প্রায় ৫ ডলার জলবায়ু ঋণ বহন করছে, যা জলবায়ু সুবিচারের বিপরীত অবস্থান। শুধু তাই নয়, শিল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত প্রতি ১ মার্কিন ডলারের বিপরীতে ৪৪ সেন্ট জলবায়ু তহবিল ছাড় করছে, অনির্দিষ্টকাল সময় দেরি করায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ শুধু অপচয়ের ঝুঁকিতে পড়ছে না, বেঅভিযোজন (Mal-adaptation) হওয়ায় মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের জীবন ও প্রাকৃতিক সম্পদ ক্ষয়ের ঝুঁকিতে পড়েছে।
জলবায়ু অর্থায়নে ন্যায়বিচার এবং সমতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জলবায়ু অর্থায়নে আমাদের একটা মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। বিদ্যমান বৈশ্বিক অতি-পুঁজিবাদী মডেল সহজাতভাবেই প্রকৃত জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং সমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে, মূল্যবোধের চেয়ে স্বার্থভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণে প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। এজন্য বাজার ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত স্বার্থের দ্বন্দ্ব গভীরভাবে পরীক্ষা করে মুনাফাভিত্তিক উদ্যোগের চেয়ে দুর্বলদের প্রয়োজনভিত্তিক সুষম ও ন্যায্যতাভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিকল্প পন্থা অন্বেষণ করতে হবে।
এর পাশাপাশি জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা প্রত্যেক দেশকে ঋণ মওকুফের বিভিন্ন উদ্ভাবনী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; ২০২৫ সাল থেকে অভিযোজন অর্থায়ন অবশ্য ১০০ শতাংশ অনুদানভিত্তিক হতে হবে। এলডিসিগুলোকে আরও সুবিধাজনক অর্থায়নের শর্ত প্রদানের জন্য বহুপক্ষীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে টেকসই অগ্রগতির আলোকে সংস্কার সাধন করার পাশাপাশি এ দেশগুলোকে জলবায়ু কার্যক্রমে সহায়তা করার জন্য জলবায়ু স্থিতিস্থাপক বন্ড এবং ডেট ফর ক্লাইমেট সোয়াপের মতো উদ্ভাবনী অর্থায়ন ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করা। শুধু তহবিলের প্রতিশ্রুতি নয়, সময়মতো প্রয়োজনীয় তহবিল প্রদান নিশ্চিত করতে হবে যে যে সম্পদ সবচেয়ে দুর্বল সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছায় এবং তাদের জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা গড়ে ওঠে। জলবায়ু অর্থ প্রবাহে আরও স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু অর্থ ব্যবস্থা, যখন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অভিযোজন এবং প্রশমনকে সমর্থন করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, এরই মধ্যে ঋণের বোঝা চাপা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অনুদানের তুলনায় অসম পরিমাণে ঋণের সমর্থন করেছে এবং তারা জলবায়ুর সঙ্গে উভয় জলবায়ু ঝুঁকির সঙ্গে দ্বিগুণ বোঝার ঝুঁকিতে রয়েছে। সেসব দেশে ক্রমবর্ধমান দুর্যোগ-সংক্রান্ত অর্থনৈতিক খরচের কারণে ঋণের ফাঁদে পড়ে। বিশ্লেষণটি আরও আন্ডারস্কোর করে যে, অভিযোজন প্রকল্পগুলো, দুর্বল সম্প্রদায়গুলোতে স্থিতিস্থাপকতা তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, প্রাথমিকভাবে প্রশমন প্রচেষ্টার তুলনায় কম অর্থায়ন করা হয়, যা প্রায়ই ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যাকে ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। এ পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, গাইবান্ধার কৃষকের ওপর যেমন, ভারতের আসাম-ত্রিপুরা-রাজস্থানের কৃষকের জন্যও একই। তাই এ পরিবর্তন মোকাবিলায় ক্ষুদ্র স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থে প্রাকৃতিক অধিকার সুরক্ষায় টেকসই পদক্ষেপ জরুরি।
লেখক: প্রধান নির্বাহী, চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ।
এ গবেষণায় সহযোগী হিসেবে ছিলেন তন্ময় সাহা, পারমিতা আরণি এবং সাদমান সাকিব খলিলী