সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। এ ছাড়া তিনি একজন আইনজীবী ও পরিবেশবিদ। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী। বাংলাদেশের বন ও পরিবেশ রক্ষা এবং এ-সংক্রান্ত আইন ও বাস্তবতা নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রীতা ভৌমিক
বাংলাদেশের বনাঞ্চল সংরক্ষণে আপনার মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পদক্ষেপ কী?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: বাংলাদেশের বনাঞ্চল সংরক্ষণে অনেক ধরনের বাধা রয়েছে। একটি আইনি বাধা, আরেকটি আইন বাস্তবায়নের বাধা। যার কারণে আমরা দখলদারিত্ব রোধ করতে পারিনি। একই সঙ্গে দেখা যায়, ব্যক্তিপর্যায়ে যেমন বনাঞ্চল দখল হয়। সরকারি পর্যায়েও কিন্তু নানান তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বনাঞ্চলের জমিটাই বেছে নেওয়া হয়। আমার অনেক দিন বন প্রশাসনে কাজ করা হয়নি, খুব অল্প সময়ে কাজ করছি, আমরা কতগুলো উল্লেখযোগ্য ধারা বেছে নিয়েছি। একটা হচ্ছে আমাদের প্রাগৈতিহাসিক বন আইন ১৯২৭ এ সংশোধনী আনা। যেখানে প্রাকৃতিক বন রক্ষায় বন বিভাগের কী দায়িত্ব সেটা সন্নিবেশ করা। ১৯২৭ সালের বন আইনে সেই বিধানটি নেই। প্রাকৃতিক বন বিভাগ রক্ষার কোনো আইনগত দায়িত্বই নেই। সে শুধু রেভিনিউ কালেক্ট করা ছাড়া। দ্বিতীয় যেটা
বেছে নিয়েছি, মানুষের অনেক কনসার্ন বন বিভাগ সামাজিক বনায়নের জন্য অনেক রাস্তার ধারে গাছ লাগায়, সেটা রক্ষণাবেক্ষণ করে। এখানে একটাই মুশকিল, গাছগুলো যখন বড় হয়ে যায়, গাছগুলো কেটে ফেলে। সামাজিক বনায়ন বিধিমালার অধীনে যারা গাছ লাগায় এবং পাহারা দেয় তাদের টাকা দেয় চুক্তির অধীনে। আমরা কাজ করছি, এই জিনিসটা একটু সংশোধন করব। গাছগুলো যাতে কাটার দরকার না পড়ে। উপকারভোগীদের অন্যভাবে উপকার দেওয়া যায়। সরকার যে বনের জমি নিয়ে নেয়, এ ব্যাপারে বেশ কয়েকটি কাজ করেছি এবং ফলও পেয়েছি। তার মধ্যে একটা কাজ হলো ২০ একর ফুটবল ফেডারেশনকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করার জন্য সরকার দেওয়ার চেষ্টা করেছিল সেটা আমরা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে বাতিল করা হয়েছে। বিকল্প কোনো জায়গা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সরকার লাঠিটিলা একটি সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক করতে চেয়েছিল। সংরক্ষিত বনে গবেষণা করা যাবে। কিন্তু সাফারি পার্ক করা যাবে না। সাফারি পার্ক পুরো উল্টো। সাফারি পার্কে মানুষ আসবে। বিদেশি প্রজাতি আসবে। ট্রেন চলবে, মানুষ হাঁটবে। একটা আনন্দ উৎসবমুখর পরিবেশ থাকবে। পরিবেশবাদীদের প্রচণ্ড আপত্তির মুখেও এই লাউয়াছড়া বনটাকে ধরে নেওয়া হয় বাংলাদেশের উন্নতমানের বন, যেটুকু রয়েছে তার মধ্যে একটা। সেখানে যে সাফারি পার্ক করার পরিকল্পনা ছিল, সেই পরিকল্পনাটা আমরা বাতিল করেছি।
বন উজাড় রোধে জনগণের অংশগ্রহণ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: সামাজিক বনায়ন বিধিমালা আমরা সংশোধন করছি। সামাজিক বনায়ন বিধিমালা সংশোধন করে গাছ যতটুকু না কাটলেই নয়, ততটুকু কাটার বিধান আনার কথা ভাবা হচ্ছে। যাতে করে যে গাছটা লাগানো হচ্ছে, সেটা রেইনট্রি হোক বা দেশীয় প্রজাতির ফলগাছ—যেগুলো আমরা রাখতে পারি। আমাদের বন বিভাগের একটা কর্মকাণ্ড ছিল, তারা প্রাকৃতিক বনের ভেতরে বন অবক্ষয়িত হয়ে গেছে, জমি দখল করতে হবে বলে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছ লাগাত। এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে—লাগিয়ে ফেলা আকাশমণি ও ইউক্যালিপটাস সামাজিক বনায়ন হলে ওটা সরিয়ে ফেলতে হবে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু হচ্ছে। সেটা হচ্ছে আমাদের বন আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার যদি কোনো বনকে রক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে, তাহলে রক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করার পর ওই বনের ওপর সরকারের যথাকর্তৃত্ব যত দায়িত্ব সবকিছু সরকার ওই বননির্ভর জনগোষ্ঠীকে দিয়ে দিতে পারে। এরপর থেকে ওই বননির্ভর জনগোষ্ঠী এ বনের দেখাশোনা করবে। এটা পার্বত্য চট্টগ্রামে হয়। ওরা বলে ফরেস্ট ভিলেজ। আইনে রয়েছে ভিলেজ ফরেস্ট। এ মডেলকে অনুসরণ করে বন আইনের ২৮ ধারায় যে বিধি প্রণয়ন করার কথা, সেটা করার জন্য একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মধুপুর শালবনে আদালতের একটা নির্দেশনা ছিল, বনকে চিহ্নিত করে সেখানে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে বনায়ন করে, সেই বনকে ফেরত আনা। স্থানীয় বনবাসীদের অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া। সেই কাজ করার জন্য হাইকোর্ট আদেশ অনুযায়ী কমিটি হয়েছে। কমিটির একটি মিটিংও হয়েছে। কাজেই আমরা সামাজিক বনায়নের আদলটা বদলাব। বনায়নের ২৮ ধারায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বন অধিদপ্তরের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব দেওয়ার যে বিধান রয়েছে, তা মাথায় রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ফরেস্ট ভিলেজ, যেখানে খুব সুন্দর বন রক্ষা করছে সেরকম মডেল আনার চেষ্টা করব।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বনভূমি পুনরুদ্ধারে আপনার কৌশল কী?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: প্রাকৃতিক বনভূমির সীমানা চিহ্নিত করা। কোনো কোনো জায়গায় বেসরকারিভাবে দখল করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো রিসোর্ট করেছে। কিন্তু রেকর্ডে এটি বনভূমি হিসেবে নিবন্ধিত না। বনভূমির সঙ্গে ভূমি প্রশাসনের একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। অনেক বন যেটি প্রটেক্টেড বন, রিজার্ভ না—সেটা ডিসির নামে লিপিবদ্ধ থাকবে। পাশে লেখা থাকবে বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভূমি রেকর্ড সংশোধন বা আপডেট করার সময় ডিসি আর সেই কথাটি লেখেন না। তার বদলে ডিসির মালিকানাধীন বলে পরিচিত মহলকে তারা লিজ দিয়ে দেয়। আবার অনেক সময় কয়েক হাত বদল করে তারা বনের জমি কিনে ফেলেন। বন বিভাগ প্রথম দিকে নির্লিপ্ত থাকে। পরে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে বলে এটা তো আমার জমি। সেজন্য প্রথমে আমার সীমানা এঁকে ফেলতে হবে। তারপর যার যার সঙ্গে আমাদের বিরোধ রয়েছে, সেই বিরোধগুলো চিহ্নিত করে আমরা এগোব।
কিন্তু গাজীপুরের একটি তালিকা নিয়ে বসেছি। সেই তালিকা ধরে আমরা দখলদারি উচ্ছেদের পরিকল্পনা করি। এ ব্যাপারে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা দ্রুত পুনরুদ্ধারে যাচ্ছি। আরেকটা পুনরুদ্ধারের উপায় হচ্ছে বন বিভাগ নিজে নিজে জমি নিয়ে ওখানে শালবন কেটে ইউক্যালিপটাস লাগায়। অথবা দেশীয় অন্যান্য প্রজাতি লাগায়। হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী, যে বনে যে গাছ লাগানোর কথা, সেই বনে সেই গাছই লাগাব। বননির্ভর জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে।
ইকো-ট্যুরিজম বনাঞ্চল ও পরিবেশের ওপর কী প্রভাব ফেলছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: ইকো-ট্যুরিজমে আমাদের কোনো গাইডলাইন নেই। তবে তাদের সঙ্গে প্রাথমিক কথা হয়েছে। আমরা শুধু বনের ওপর নয়, বন, হাওর, রাতারগুলে যে সোয়াম ফরেস্ট রয়েছে, লক্ষ্মীর বাঁওড় আছে, সুন্দরবন আছে। এগুলো সব একসঙ্গে করে সাধারণ কিছু গাইডলাইন দেওয়া হবে। যাতে ইকো-ট্যুরিজম বা ট্যুরিজমের কারণে কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। কিন্তু বিভিন্ন দ্বীপ রয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও করব। পর্যটকরা কী কাজ করতে পারবেন, কী কাজ করতে পারবেন না; এ তালিকাটা ট্যুরিজম বোর্ড, ট্যুরিজম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে করার জন্য প্রাথমিক কথা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কোন এলাকায় পড়ছে? বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনের সফলতা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? জলবায়ু শরণার্থীদের জন্য সরকারের কী পরিকল্পনা আছে? জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সাহায্য কতটুকু কার্যকর হচ্ছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। বাংলাদেশে বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের প্রবণতা বেশি। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ দুই ও সাত নম্বরে রয়েছে। যেভাবে করে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানি যদি নিয়ন্ত্রণে না আনে তাহলে দেখা যাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে উপকূলের যে ১৯টি জেলা রয়েছে, তা সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সারা দেশে এবারের মত তাপপ্রবাহ আগে কখনো দেখিনি। নোয়াখালীর বন্যায় ফসলহানি, প্রাণহানি হলো, স্থাপনার ক্ষতি হলো। জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, গবাদি পশুর ক্ষতি হলো। মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হলো।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেমন কাজ করতে হবে, উন্নতবিশ্ব যেমন তাদের মডেল বদলায়, তেমনিভাবে উন্নত বিশ্বকে তারা আন্তর্জাতিক আইনে বলেছে আমাদের অতিরিক্ত এবং নতুন টাকা দেবে; সেটা নিয়েও কথা বলতে হবে। লস এন্ড ডেমেজ নিয়ে একটি তহবিল হয়েছে। আমাদের নোয়াখালীর বন্যার যে অবস্থা, নোয়াখালীর বন্যাও লস এন্ড ডেমেজ রোধ করার জন্য ফান্ডের টাকা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। ওখানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা দুই লেভেলে কাজ করব। এক. তাদেরকে তাদের উন্নয়ন মডেল বদলাতে হবে। আমাদের জিম্মি করে তাদের উন্নয়ন মডেল চলতে পারে না। তারা কম কার্বন নিঃসরণ হয় এমন উন্নয়ন মডেলে যাবে। দ্বিতীয় হচ্ছে, আমাদের যে পাওনা টাকা তারা আমাদের দেবে। যাতে আমরা ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারি। উন্নত বিশ্ব আজ থেকে যদি বিধ্বংসী কাজগুলো না করে—এ যাবৎ যে কাজগুলো হয়েছে, সেগুলোর ক্ষতিগুলো পোষাতে অভিযোজনের কাজে আমাদের কারিগরি এবং আর্থিক সহায়তা চাইব। যদি উন্নত বিশ্ব আমাদের চাহিদা মোতাবেক টাকা না দেয়, যেটা আজ পর্যন্ত তারা দেয়নি, তাহলে কিন্তু আমাদের নিজেদের প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের বন্যা সহিষ্ণু ধানের কথা, খরা সহিষ্ণু ধানের কথা ভাবতে হবে। আমাদের বিকল্প চাষাবাদের কথা ভাবতে হবে। এই কাজগুলো আমার মন্ত্রণালয় এককভাবে করবে না। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে করতে হবে। সেজন্য আমাদের ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যানও রয়েছে।
বাংলাদেশে পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: নীতিনির্ধারণীতে সরকারের দুই ধরনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয় রিভিউ করছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি সর্বোচ্চ মাত্রায় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ‘থ্রি জিরো’ থিওরির কথা বলেন। এর মধ্যে একটা জিরো হচ্ছে, ফসিল ফুয়েল কোনোভাবে করা যাবে না। ফসিল ফুয়েল বার্নিং কমাতে হবে। এই জিরো কার্বন যেহেতু তার ব্যক্তিগত দর্শনের অংশ, সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে বাংলাদেশ দ্রুততার সঙ্গেই এগোবে।
প্লাস্টিক দূষণ রোধে মন্ত্রণালয়ের নেওয়া পদক্ষেপগুলো কতটুকু কার্যকর হয়েছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: প্লাস্টিক দূষণ রোধ নিষিদ্ধকরণ কার্যকর করা হয়েছে। সুপার শপগুলোর কর্ণধারদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, প্লাস্টিক দূষণ রোধে ১ নভেম্বর থেকে তারা কোনো প্লাস্টিক ব্যাগ ক্রেতাদের দেবে না। মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠিয়েও ক্রেতাদের বলা হচ্ছে, বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে আসুন। নতুবা আমাদের থেকে ব্যাগ আপনারা কিনে নেন। মানুষেরও একটা অভ্যস্ততার ব্যাপার রয়েছে। এটা নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়, নিষেধাজ্ঞা ২০০২ সালের ছিল। এই নিষেধাজ্ঞা নতুন করে প্রয়োগের চেষ্টা করা হচ্ছে। ১ নভেম্বর থেকে কাঁচাবাজারে এ নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ শুরু হবে। একইভাবে পলিথিন উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হবে। প্লাস্টিক যারা উৎপাদন করে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং কাঁচাবাজারের মালিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত এটা কার্যকর ছিল। নিয়মিত বাজার মনিটরিং হচ্ছে। আমরাও নিয়মিত বাজার মনিটরিং করব। এই মুহূর্তে মানুষ আগের চেয়ে অনেক সচেতন। ২০০২ সালে মানুষ জানত না তার ব্রেনের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে গেছে। এখন কিন্তু এই কথা মানুষ জানে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্লাস্টিক দূষণ রোধে আইন হচ্ছে। অনেক দেশে যেমন মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, ভারতের চেন্নাইসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পলিথিন ব্যাগ এবং একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক থেকে ক্রমান্বয়ে সরে আসার কাজ শুরু হয়েছে। এটা যেহেতু আইন এটা তো প্রয়োগ করতেই হবে। ঐকমত্যে হলে খুবই ভালো নইলে আমাদের অভিযানে যেতে হবে।
নদী দূষণ কমাতে কোন উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আমরা আটজন বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে সভা করেছি। সে সভায় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন উপদেষ্টা, জাতীয় নদী রক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন, সব দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা এবং আমি ছিলাম। সব বিভাগীয় কমিশনকে বলা হয়েছে ৬৪টি জেলা থেকে একটি করে নদী চিহ্নিত করতে। যেটাতে উনারা দখল উচ্ছেদ, দূষণ রোধে কাজ করবেন। ঢাকা শহরের নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করতে কী করা যায়, সেজন্য বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে একটি সভা করেছি। ঢাকা শহরের নদীগুলোর দূষণকারীর সম্পূর্ণ কোনো তালিকা আমাদের নেই। সেই তালিকাটা দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রণয়ন করে সেক্টরগুলো চিহ্নিত করে আমরা দূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করব। ঢাকা শহরের একটি নদীকে বেছে নিয়ে শিল্প দূষণ এবং মিউনিসিপ্যাল বর্জ্য ফেলা হয় সেটা রোধ করা হবে। নদীর পয়ঃবর্জ্য দূষণমুক্ত করার সময় হয়তো আমরা পাব না। তবে চিহ্নিত হলে আগামী অর্থবছরের জন্য যদি আমরা টার্গেট করি, নদীগুলোকে বাঁচাতে হলে সিওয়েস্ট প্লান্ট স্থাপন করতে হবে। শিল্প দূষণ এবং গৃহস্থালি বর্জ্য দিয়ে নদী যাতে আর দূষিত না হয়, সেই কাজটা আমরা শুরু করে দিতে পারব।
বায়ুদূষণ মোকাবিলায় ঢাকা শহরের জন্য কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ কর্মপরিকল্পনা ২২ সেপ্টেম্বর কেবিনেট ডিভিশন দ্বারা অনুমোদিত হয়েছে। এই অ্যাকশন প্ল্যান ধরে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা আমাদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। সেখানে আমরা প্রাধান্য চিহ্নিত করে বায়ুদূষণের কাজে যাব। তার আগে ঢাকা শহরে যেন পানি ছিটানো শুরু হয়। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে কথা হয়েছে, অনতিবিলম্বে এ কাজটা শুরু হবে। ঢাকার আশপাশে সাড়ে তিন হাজারের মতো অবৈধ ইটভাটা রয়েছে, শিঘ্রই এগুলো ভেঙে দেওয়ার কাজটা শুরু করব।
পরিবেশ সংরক্ষণে আইন বাস্তবায়নে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: পরিবেশ অধিদপ্তরের এক ধরনের নির্লিপ্ততা ছিল। তাদের যে সাহস দেবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবসময় সেই সাহসটা দেয়নি। বরং রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেখা গেছে, দূষণকারীর পক্ষেই কাজ করেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর চাইলেও কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়নি। আবার স্বচ্ছতারও একটার অভাব ছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরে যেহেতু লোকবলের সংকট রয়েছে, সবাইকে একসঙ্গে টার্গেট না করে, সবচেয়ে বেশি দূষণকারীকে টার্গেট করে সেগুলোকে নিয়মিত মনিটরিংয়ে আনা, স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা—এসব কাজ করতে হবে। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান দিনের বেলা বর্জ্য ফেলবে না। কিন্তু রাতের অন্ধকারে লুকানো পাইপ দিয়ে তারা বর্জ্যটা ফেলে দেবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী যদি সজাগ থাকে, তাহলে তারা আমাদের দ্রুত সংবাদটা দিতে পারবে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানে একটি নীতি—যে দূষণ করবে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। টেকসই উন্নয়ন পূর্ব সতর্কতামূলক নীতিতে এসব নীতি সন্নিবেশিত করা হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পরিবেশ দূষণকারীর শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তালিকা ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে কখন আমরা কী ব্যবস্থা নেব সেটাও আমরা ওয়েবসাইটে দিয়ে দেব। জনগণ যে অভিযোগ করে তা একটি রেজিস্টারে তারিখসহ তালিকাভুক্ত করা, কত তারিখে নিষ্পত্তি হয়েছে তাও লিপিবদ্ধ করার কাজটি জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
পরিবেশগত বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: মাধ্যমিক পাঠ্যক্রম পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। আমার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পলিথিন এবং প্লাস্টিকের বিষয়ে একটি লেখা পাঠিয়ে দিয়েছি। এই পর্যায়ে তারা সময় পাবেন কি না, কারণ বই ছাপানোর একটা তাড়া রয়েছে। যদি সময় পান, তাহলে খুব ভালো কথা। তাহলে এই বিষয়টা সংযুক্ত হবে। সময় না পেলে তারা আমাদের বলেছেন, আগামী বছর এটাকে আবার নতুন করে রিভাইস করা হবে, অবশ্যই এটাকে বিবেচনায় রাখবেন।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের নীতি ও কৌশল কি আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশনাল প্ল্যান করেছি। এটা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যে কৌশলগুলো আছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
পরিবেশগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আপনার প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী বলে মনে করেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: চ্যালেঞ্জ আগের থেকে বদলে যায় না। এবারের চ্যালেঞ্জ হলো, আগে দাবি করতাম এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। এত বছর ধরে দাবি করে এসেছি, কিছু দাবি পূরণ হয়েছে। উচ্চ আদালতকে সরকার সম্মান করত। একপর্যায়ে উচ্চ আদালতকে সরকার নিজের একটি অস্ত্র মনে করত। তখন উচ্চ আদালতের আদেশগুলো বাস্তবায়ন করেনি। আমার প্রথম কাজ হবে উচ্চ আদালতের অনেক আদেশ আছে, অনেক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে—সেগুলো বাস্তবায়ন করা। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের যে আইনি উইং আছে, সেটাকে শক্তিশালী করা। আগে যে আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো ছিল উন্নয়ন বনাম পরিবেশ—সেখানে আমি মনে করি, এখন একটা পরিবর্তন এসেছে। এখন পরিবেশকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আমরা দেখেছি নদীগুলো দখল করে দূষণ করা হয়েছে। চ্যালেঞ্জ হবে কার্যক্রমকে সমন্বিত করা। শিল্প মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে যদি কথাটা বলতে পারি, তাহলে অনেক শক্ত হবে। শিল্প মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটা সমন্বয়। শিল্প উৎপাদনকে ব্যাহত না করে কীভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, একটা কর্মপরিকল্পনা, ঐকমত্যে পৌঁছানো একটা চ্যালেঞ্জ। আমরা মনে করি না এটা উতরাতে পারব না। বহু বছর এগুলো বলা হয়েছে। এখন জনগণ কাজ দেখতে চায়। জনগণ যে শুধু আমার থেকে কাজ দেখতে চায় তা নয়, জনগণ শিল্প-মালিককেও পরিবর্তিত দেখতে চায়। তাদের কাছ থেকেও সংস্কার আশা করে। আমাদের একটা নতুন অডিয়েন্সকে, নতুন প্রজন্মকে বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হচ্ছে। আশা করি চ্যালেঞ্জগুলো আমরা উতরাতে পারব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। রিভার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কর্তাব্যক্তিরা আমাকে বলেছেন, আমাদের রিসার্চ করার জন্য মাত্র ৪৫ লাখ টাকা আছে। এই যে প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকা, সেটাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ। আশা করছি আমরা আগামী বছর থেকে এটাকে উত্তোলন করতে পারব।