আল্লাহতায়ালা যেমন পর্যবেক্ষণ করছেন, তেমনি ফেরেশতারাও সতত আমলনামায় লিপিবদ্ধ করছেন। কেয়ামতের দিন সব আমাদের সামনে তুলে ধরা হবে। তখন অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকবে না। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে কোনো কথা উচ্চারণের সময় মানুষের কাছে লেখার জন্য সদা তৎপর একজন প্রহরী ফেরেশতা উপস্থিত থাকেন’
অনর্থক আচরণ ও উচ্চারণ পরিহার করা ইমান ও ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, ‘অর্থহীন কথাবার্তা ও কাজকর্ম থেকে নিজের আঁচল বাঁচিয়ে চলা ইসলামের অন্যতম শোভা ও সৌন্দর্য।’ (তিরমিজি: ২৩১৭)। আল্লাহতায়ালা প্রিয় বান্দাদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের বিবরণ তুলে ধরেছেন এভাবে—‘আর যখন তারা অহেতুক ও অনর্থক কাজকর্মের পাশ কেটে অতিক্রম করে তখন তারা ভদ্রতা বজায় রেখে পার হয়ে যায়।’ (সুরা ফোরকান: ৭২)। সফল মুমিনের পরিচয় বর্ণনা করেছেন এভাবে—‘আর যারা অর্থহীন কথা ও কাজ পরিহার করে ও তার প্রতি বিমুখতা প্রদর্শন করে।’ (সুরা মুমিনুন: ৩)।
কিন্তু আমরা কজন ইসলামের এ সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারি? মুমিনের এ বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে পারি? অনর্থক কথা ও কাজের উপলক্ষ আসতে দেরি; শুরু হয়ে যায় কে কার আগে লুফে নেবে সে প্রতিযোগিতার সুযোগ। ঘরে-বাইরে, কফি হাউসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিস-আদালতে যে কোনো জায়গায় দুজন একত্র হলে কিংবা চার-পাঁচজনের জটলা হলে শুরু হয়ে যায় মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, পরনিন্দা, পরচর্চা ইত্যাকার অর্থ-উদ্দেশ্যহীন কথাবার্তা, যা অনেক সময় পরকালীন ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে ইহকালীন বহু ক্ষতিও বয়ে আনে। পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, বৈবাহিক বন্ধন ছিন্ন হয়, সামাজিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়, এমনকি অনেক সময় মারামারি-হানাহানি পর্যন্ত নিয়ে যায় দু-চার মিনিটের অসতর্ক ও অসংযত কথাবার্তা।
আকাশ-সংস্কৃতির এই চরমোৎকর্ষের যুগে অর্থহীন ক্রিয়াকলাপের দ্বার তো আরও বেশি উন্মুক্ত হয়ে গেছে। তাই তো আমরা দেখতে পাই, বহু তরুণ-তরুণীর রাত-দিন একাকার হয়ে বিনিদ্র রজনী ভোর হয়ে যায় ইন্টারনেট ও ফেসবুকের অবাধ বিচরণে। কেউ মেসেঞ্জারে অবৈধ চ্যাট করছে, কেউ একটু পরপর নতুন নতুন পিক আপলোড করছে, কেউ নোংরা ও অশ্লীল ভিডিও দেখে নিজের জীবনীশক্তি ক্ষয় করছে, কেউ নানা ধরনের গেমস নিয়ে রাত-দিন বুঁদ হয়ে পড়ে থাকছে। এভাবে কত নিষ্প্রয়োজনীয় কার্যকলাপে আমাদের জীবনের অমূল্য সময় তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, কে তার হিসাব রাখে। অথচ মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত ছিল, হিসাব করে করে একেকটা মুহূর্ত ব্যয় করা, সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য সামনে রেখে সার্থক জীবনযাপন করা এবং সব ধরনের নেতিবাচক কথা ও কাজ বর্জন করা। আর এটা তখনই সম্ভব যখন আমরা সামনের বিষয়গুলোর প্রতি সুদৃঢ় বোধ-বিশ্বাস রাখব।
আমরা যে জবান দিয়ে কথা বলি এবং যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে কার্যসম্পাদন করি, সব আল্লাহতায়ালার একেকটি মহামূল্যবান নিয়ামত। আর খোদাপ্রদত্ত প্রতিটি নিয়ামত সম্পর্কে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতঃপর অবশ্যই তোমরা সব নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সুরা তাকাসুর: ৮)। আমাদের প্রতিটি আচরণ ও উচ্চারণ আল্লাহতায়ালা যেমন পর্যবেক্ষণ করছেন, তেমনি ফেরেশতারাও সতত আমলনামায় লিপিবদ্ধ করছেন। কেয়ামতের দিন সব আমাদের সামনে তুলে ধরা হবে। তখন অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকবে না। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে কোনো কথা উচ্চারণের সময় মানুষের কাছে লেখার জন্য সদা তৎপর একজন প্রহরী ফেরেশতা উপস্থিত থাকেন।’ (সুরা কাফ: ১৮)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন আমলনামা পেশ করা হবে তখন তুমি অপরাধীদের আমলনামার লেখা দেখে ভীতসন্ত্রস্ত দেখতে পাবে। তারা বলবে, হায়, এ দেখি আশ্চর্য আমলনামা, ছোট-বড় প্রতিটি বিষয়কেই সংরক্ষণ করে রেখেছে।’ (সুরা কাহাফ: ৪৯)
অনেক সময় একটা কথা কিংবা একটা কাজই মানুষের ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট হয়। যার ফলে নিক্ষিপ্ত হতে হবে জাহান্নামের অতল গহ্বরে। এক সফরে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লাম হজরত মুয়াজ বিন জাবালকে কথা প্রসঙ্গে বললেন, মুয়াজ! তুমি এই জবানকে হেফাজত করো। তিনি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর নবী! আমাদের কি আমাদের কথার কারণে পাকড়াও করা হবে? নবীজি (সা.) উত্তর দিলেন, হে মুয়াজ! মানুষদের উপুড় হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ তো তাদের এ বাক্যবাণেরই ফল হবে।’ (তিরমিজি: ২৬১৬)।
আল্লাহতায়ালা সবাইকে পরিহার ও পরিত্যাগের এ সংযমী চরিত্র গ্রহণ করে এবং ইসলামের সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রেখে তার প্রিয় বান্দা হওয়ার তওফিক দান করুন।
লেখক: ইমাম ও খতিব