পৃথিবীতে আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন শুধু তার ইবাদত করার উদ্দেশ্যে। তবে পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে শয়তানকেও পাঠানো হয়েছে; সে মানুষকে সে উদ্দেশ্য থেকে চ্যুত করে অন্য শক্তির উপাসনায় নিয়োজিত করতে সদা সচেষ্ট থাকবে। আল্লাহর উপাসনা ছেড়ে অন্য শক্তির উপাসনা করাকে বলা হয় ‘শিরক’। পৃথিবীতে আল্লাহর অবাধ্যতার সূচনা হয় শিরক তথা মূর্তিপূজার মাধ্যমে। পৃথিবীর প্রথম মানুষ হজরত আদম (আ.)-এর সময় সবাই আল্লাহর ইবাদত করত। তার সময় পৃথিবীতে মানবসভ্যতার উন্মেষ ঘটে। তার ওপর যেসব ঐশী বিধান অবতীর্ণ হতো, সেসবের অধিকাংশই ছিল পৃথিবী আবাদকরণ ও মানবীয় প্রয়োজনাদির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে কালের বিবর্তনে মানুষের মধ্য শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মুহাম্মদ ইবনে কায়েস বলেন, হজরত আদম ও নুহ (আ.)-এর মধ্যবর্তী সময়কালে পাঁচজন সৎকর্মশীল মানুষ ছিলেন। তাদের মৃত্যুর পর ভক্ত অনুসারীদের শয়তান এই বলে প্ররোচনা দেয় যে, এসব সৎ মানুষের প্রতিকৃতি সামনে থাকলে তাদের দেখে আল্লাহর ইবাদতে অধিক আগ্রহ সৃষ্টি হবে। ফলে তারা তাদের মূর্তি বানায়। তারপর মূর্তিনির্মাতা প্রজন্মের মৃত্যুর পর পরবর্তী প্রজন্ম শয়তানের ধোঁকায় পড়ে সরাসরি মূর্তিগুলোকেই উপাস্য হিসেবে পূজা শুরু করে দেয়। (বোখারি, হাদিস: ৪৯২০)। আর এভাবেই পৃথিবীতে প্রথম মূর্তিপূজার শিরকের সূচনা হয়। পরবর্তীকালে আরবদের মধ্যেও এসব মূর্তির পূজা চালু ছিল। বনি কালব গোত্রে ছিল ‘ওয়াদ’ মূর্তি, বনি হোজায়েল গোত্রে ছিল ‘সুওয়া’ মূর্তি, বনি গুতায়েফ গোত্রে ছিল ‘ইয়াগুস’ মূর্তি, বনি হামদান গোত্রে ছিল ‘ইয়াউক’ মূর্তি এবং হিমইয়ার গোত্রে ছিল ‘নাসর’ মূর্তি। (বোখারি, হাদিস: ৪৯২০)। তাফসিরের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, এই পাঁচজন সৎকর্মশীল মানুষের মধ্যে প্রথম ছিলেন ‘ওয়াদ’। তিনি মৃত্যুবরণ করলে মানুষরা তার ভক্তিতে কান্নায় ভেঙে পড়ে। শয়তান এ সুযোগ গ্রহণ করে এবং উত্তরসূরিদের তার প্রতিকৃতি বানাতে প্ররোচনা দেয়। ফলে ‘ওয়াদ’-এর প্রতিকৃতিই হলো পৃথিবীর সর্বপ্রথম মূর্তি, আল্লাহকে বাদ দিয়ে যার পূজা শুরু হয় (তাফসিরে ইবনে কাসির, সুরা নুহ)। মানুষের হৃদয়ে এই পাঁচ ব্যক্তির শ্রদ্ধা এবং এই পাঁচ মূর্তির মাহাত্ম্য এমনভাবে প্রোথিত হয়ে যায় যে, তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এবং পারস্পরিক চুক্তি সম্পাদনকালে তাদের নাম উল্লেখ করতে থাকে। তখন তাদের হেদায়াতের জন্য হজরত নুহ (আ.)-কে রাসুল হিসেবে পাঠানো হয় (সুরা আরাফ: ৬১)।
পৃথিবীর প্রথম মানুষ হজরত আদম (আ.) এবং প্রথম রাসুল হজরত নুহ (আ.)। হজরত আদম (আ.) পৃথিবীতে আগমনের প্রায় দুই হাজার বছর পর পৃথিবীতে আগমন করেন হজরত নুহ (আ.)। আর এই দুই হাজার বছরের মধ্যেই মানুষের মধ্যে আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি মূর্তির উপাসনা শুরু হয়ে যায়। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদিসে এসেছে, কেয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে দিশেহারা মানুষ হজরত নুহ (আ.)-কে বলবে, ‘আপনি পৃথিবীতে প্রেরিত প্রথম রাসুল। আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪৩১২)। হজরত আবু উমামা (রা.)-এর বর্ণনা মতে, পৃথিবীতে হজরত আদম (আ.)-এর আগমনের এক হাজার বছর পর হজরত নুহ (আ.)-এর আগমন হয় (ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৪০)। তিনি ছিলেন হজরত আদম (আ.)-এর দশম অধঃস্তন পুরুষ। তার বংশধারা হচ্ছে—নুহ ইবনে লামেক ইবনে মুতাওয়াশশালেখ ইবনে খানুক ইবনে ইয়ারদ ইবনে মাহলাইল ইবনে কিনান ইবনে আনুশ ইবনে শিস ইবনে আদম। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, হজরত নুহ (আ.) ৯৫০ বছর জীবন পেয়েছিলেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, তিনি চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়তপ্রাপ্ত হন এবং মহাপ্লাবনের পর ষাট বছর জীবিত ছিলেন। হজরত নুহ (আ.) বর্তমান ইরাকের মুসল নগরীতে নিজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বসবাস করতেন। মানুষরা হজরত আদম (আ.)-এর শরিয়ত অনুযায়ী তওহিদের অনুসারী এবং একই উম্মতভুক্ত ছিল। তবে শয়তানের ধোঁকায় মানুষের মধ্যে মূর্তিপূজা শুরু হলে তিনি মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করতে থাকেন। তিনি তাদের দিন-রাতে, প্রকাশ্যে-গোপনে, সম্মিলিত ও একান্তে বিভিন্ন পন্থায় দাওয়াত দিতে থাকেন। কিন্তু ফল হয় নিতান্ত নৈরাশ্যজনক। তার দাওয়াতে অতিষ্ঠ হয়ে তারা তাকে দেখলেই পালিয়ে যেত। কখনো কানে আঙুল দিত। কখনো তাদের চেহারা কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলত। কওমের সর্দাররা লোকদের ডেকে বলত, ‘খবরদার, তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের পূজিত উপাস্য ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগুস, ইয়াউস ও নাসরকে কখনোই পরিত্যাগ করবে না।’ (সুরা নুহ: ২১-২৩)।
হজরত নুহ (আ.) টানা ৯৫০ বছর মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করেন। অল্প কিছু মানুষ তার আহ্বানে সাড়া দেয়। একসময় নুহ (আ.) তাদের ইমান আনার ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়েন। তাই তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! আপনি পৃথিবীতে কোনো কাফের গৃহবাসীকে রেহাই দেবেন না। যদি আপনি তাদের রেহাই দেন, তবে তারা আপনার বান্দাদের পথভ্রষ্ট করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে শুধু পাপাচারী, কাফের।’ (সুরা নুহ: ২৬-২৭)। আল্লাহতায়ালা নুহ (আ.)-এর দোয়া কবুল করলেন এবং অহির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিলেন। আল্লাহতায়ালা বললেন, ‘তুমি একটি নৌকা তৈরি করো। এরপর যখন আমার আদেশ আসবে এবং চুল্লি প্লাবিত হবে, তখন নৌকায় তুলে নেবে প্রত্যেক জীবের এক এক জোড়া এবং তোমার পরিবারবর্গকে, তাদের মধ্যে যাদের বিপক্ষে পূর্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাদের ছাড়া এবং তুমি জালেমদের সম্পর্কে আমাকে কিছু বলবে না। নিশ্চয়ই তারা নিমজ্জিত হবে।’ (সুরা মুমিনুন: ২৭)। নুহ (আ.) যখন নৌকা বানাতে শুরু করেন তখন সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে নানাভাবে তিরস্কার করতে লাগল। তারা বলত, হে নুহ! আশপাশে কোথাও তো নদীনালা নেই, তাহলে তুমি এই জাহাজ নির্মাণ করছ কেন? মাটিতেই কি জাহাজ চালাবে? তারা টিপ্পনী কেটে বলত, এতদিন ছিলে নবী, নবুয়তি ছেড়ে এখন হয়েছে কাঠমিস্ত্রি! পবিত্র কোরআনের সুরা হুদে পরপর ১২টি আয়াতে আল্লাহ সে ঘটনা মৌলিকভাবে বিবৃত করেছেন, ‘তুমি আমার চোখের সামনে আমার নির্দেশনা মোতাবেক একটা নৌকা তৈরি করো। স্বজাতির প্রতি দয়াপরবশ হয়ে জালেমদের ব্যাপারে আমাকে কোনো কথা বলো না। অবশ্যই ওরা ডুবে মরবে।’ তখন নুহ (আ.) নৌকা তৈরি শুরু করলেন। তিনি নৌকাও চিনতেন না, তৈরি করতেও জানতেন না। হজরত জিবরাইল (আ.) এসে নৌকা তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ ও নির্মাণ কৌশল শিখিয়ে দিলেন। এভাবে সরাসরি ঐশী পৃষ্ঠপোষকতায় হজরত নুহ (আ.)-এর হাতে নৌকা ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। তার কওমের নেতারা যখন পাশ দিয়ে যেত, তখন তারা তাকে বিদ্রূপ করত। নুহ তাদের বললেন, ‘তোমরা যদি আমাদের উপহাস করে থাকো, তবে জেনে রেখো তোমরা যেমন আমাদের উপহাস করছ, আমরাও তোমাদের উপহাস ফিরিয়ে দেব। অচিরেই তোমরা জানতে পারবে লাঞ্ছনাকর আজাব কাদের ওপর আসে এবং কাদের ওপর নেমে আসে চিরস্থায়ী গজব।’ তারপর বর্ণিত হয়েছে, ‘অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে গেল এবং রান্নার চুলা থেকে পানি উথলে উঠল, তখন আমি বললাম, সর্বপ্রকার জোড়ার দুটি করে এবং যাদের ওপরে পূর্বেই হুকুম নির্ধারিত হয়ে গেছে, তাদের বাদ দিয়ে তোমার পরিবারবর্গ ও সব ইমানদারকে নৌকায় তুলে নাও। নুহ তাদের বললেন, তোমরা এতে আরোহণ করো। আল্লাহর নামেই এর গতি ও স্থিতি। নিশ্চয়ই আমার প্রভু অতীব ক্ষমাশীল ও দয়াবান। অতঃপর নৌকা তাদের বহন করে নিয়ে চলল পাহাড়ের মতো তরঙ্গমালার মধ্য দিয়ে। এ সময় নুহ তার পুত্র ইয়ামকে ডাকলেন, যখন সে দূরে ছিল, হে আমার পুত্র! আমাদের সঙ্গে আরোহণ করো, কাফেরদের সঙ্গে থেকো না। সে বলল, অচিরেই আমি কোনো পাহাড়ে আশ্রয় নেব, যা আমাকে প্লাবন থেকে রক্ষা করবে। নুহ বললেন, আজকের দিনে আল্লাহর হুকুম থেকে কারও রক্ষা নেই, একমাত্র তিনি যাকে দয়া করবেন সে ব্যতীত। এমন সময় পিতা-পুত্র উভয়ের মধ্যে বড় একটা ঢেউ এসে আড়াল করল এবং সে ডুবে গেল। অতঃপর নির্দেশ দেওয়া হলো, হে পৃথিবী! তোমার পানি গিলে ফেলো অর্থাৎ হে প্লাবনের পানি! নেমে যাও। হে আকাশ! ক্ষান্ত হও অর্থাৎ তোমার বিরামহীন বৃষ্টি বন্ধ করো। অতঃপর পানি হ্রাস পেল ও গজব শেষ হলো। ওদিকে জুদি পাহাড়ে গিয়ে নৌকা ভিড়ল এবং ঘোষণা করা হলো, জালেমরা নিপাত যাও।’ (সুরা হুদ: ৩৭-৪৪)।
জলতুফানের সময় ভূতলের উত্থিত পানি ছাড়াও যুক্ত হয়েছিল অবিরাম ধারে আকাশবন্যা। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তখন আমি খুলে দিলাম আকাশের দুয়ারসমূহ প্রবল বারিপাতের মাধ্যমে। এবং ভূমি থেকে প্রবাহিত করলাম নদীসমূহকে। অতঃপর উভয় পানি মিলিত হলো একটি পূর্ব নির্ধারিত কাজে অর্থাৎ ডুবিয়ে মারার কাজে। আমি নুহকে আরোহণ করালাম এক কাষ্ঠ ও পেরেক নির্মিত জলযানে, যা চলত আমার দৃষ্টির সম্মুখে।’ (সুরা কামার: ১১-১৫)। যে কারণে নুহপুত্র ‘ইয়াম’ পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েও রেহাই পায়নি। ওই সময় কোনো কোনো ঢেউ পাহাড়ের চূড়া থেকেও উঁচু ছিল। ইয়ামকে যে পানি ডুবিয়ে মেরেছিল তার স্মৃতি হিসেবে সমুদ্রকে আরবিতে ইয়াম বলা হয়। আর নুহ থেকেই সম্ভবত নৌকা নাবিক নেভাল নৌযান ইত্যাদি শব্দের উদ্ভব হয় বলে গবেষকদের অভিমত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত নুহ (আ.)-এর নৌকায় আরোহী মানুষের সংখ্যা ছিল চল্লিশজন করে পুরুষ ও নারী, মোট আশিজন।
৫ মাস ১২০ দিন প্লাবনের তরঙ্গে ভাসমান সময় শেষে হজরত নুহ (আ.)-এর নৌযান বর্তমান ইরাকের মসুল শহরের উত্তর দিকে জুদি পর্বতমালার পাদদেশে গিয়ে স্থির হয়ে নোঙর করে। জুদি বিশাল এলাকা নিয়ে প্রসারিত একটি পাহাড়। এই পাহাড়ে ওক কাঠের বৃক্ষ জন্মে। প্রায় তিন দিনের দূরত্ব পরিমাণ এর বিস্তৃতি। হজরত নুহ (আ.) উত্তর ইরাকের ইবনে ওমর দ্বীপের অদূরে আর্মেনিয়া সীমান্তে অবস্থিত মসুল শহরের এ পাহাড়ের পাদদেশেই বসতি স্থাপন করেন। এর অন্য এক অংশের নাম ‘আরারাত’ পর্বত। নৌযানে যেহেতু ৮০ জন আরোহী ছিল এবং পৃথিবীর নতুন ও একমাত্র জনপদের বাসিন্দা মাত্র ৮০ জন, তাই এর নাম দেওয়া হয় ‘কারয়াতুস সামানিন’ অর্থাৎ ‘আশিজন মানুষের জনপদ’। বর্তমানেও উত্তর ইরাকে মসুল শহরের কাছে এলাকাটি হুবহু এ নামেই বিদ্যমান। (মুহাম্মাদ সুলাইমান আত-তাইয়েব, মাউসুআতুল কবাইলিল আরাবিয়্যাহ: ১/২৬)। নুহ (আ.)-এর পরিবারবর্গ ও সেই আশিজনই পত্তন করেন আজকের মানবসভ্যতা। তাই নুহ (আ.)-কে বলা হয় ‘আদম সানি’ বা দ্বিতীয় আদম। মহাপ্লাবন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষদের তৎকালীন ভাষায় বলা হতো ‘সুমের’। তাদের থেকেই উদ্ভব হয় ‘সুমেরি সভ্যতা’ এবং তারা যে শহরের গোড়াপত্তন করে, সেটার নাম দেওয়া ‘সানআ’, যার অর্থ সুরক্ষিত এবং নির্মিত শহর। বর্তমানে ইয়েমেনের রাজধানী। মানব ইতিহাসের এসব অতীত ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি, আবারও মানুষ যখন পাপাচারে লিপ্ত হবে, ইমান ছেড়ে কুফুরি গ্রহণ করবে, শিরকে লিপ্ত হবে তখন আল্লাহ আজাব নাজিল করবেন এবং পুরো দুনিয়া ধ্বংস করে দেবেন।
লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ