সমাজকল্যাণে দেবী দুর্গার আশ্বাস সাংবাৎসরিক মহাপূজা ‘দুর্গাপূজা’য় বেগবান করার কৌশল অনুসন্ধান করে তা বাস্তবায়নে অগ্রসর হলে সমাজকল্যাণ তথা সনাতনী ও দেশজ উন্নয়নে বড় অবদান রাখা সম্ভব হবে।
সমাজ বা জনসমষ্টির সার্বিক মঙ্গল সাধনকে সমাজকল্যাণ বলে অভিহিত করা হয়। সমাজকল্যাণ সামষ্টিক ধারণা। এর ফলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ উপকৃত হয়ে থাকে। মানুষের অপরিহার্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত চাহিদা পূরণের জন্য বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে আমরা সমাজকল্যাণ হিসেবে চিহ্নিত করি। সমাজকল্যাণের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রণিধানযোগ্য।
ক) সুসংগঠিত ব্যবস্থা খ) বিজ্ঞানসম্মত ও পরিকল্পিত গ) সর্বজনীন ও লক্ষ্যাভিমুখী ঘ) সক্ষমতার বিকাশ ও স্বাবলম্বীকরণ ঙ) অংশগ্রহণমূলক প্রচেষ্টা।
দেবী দুর্গার পূজার কার্যক্রম শুরু থেকে শেষ অবধি সমাজকল্যাণের প্রাগ্রসর চিন্তায় সজ্জিত। বনেদি মুষ্টিমেয় পরিবার ব্যতীত বর্তমান সময়ে অধিকাংশ পূজাই সর্বজনীন বা সম্মিলিত উদ্যোগেই আয়োজিত হয়।
দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের যে ব্যয় তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীদের অনুদান বা সহায়তায় নির্বাহ করা হয়ে থাকে। যাদের আর্থিক সামর্থ্য বেশি, তাদের অপেক্ষাকৃত বেশি অনুদান দিতে হয়। যাদের আর্থিক সামর্থ্য কম, তারাও শ্রম দিয়ে বা অন্যান্য উপায়ে পূজার কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেন। অর্থাৎ দুর্গাপূজা মূলত জনউদ্যোগের আরাধনা। সমাজের ঐক্য প্রতিষ্ঠার এটি একটি ক্ষেত্রও বটে।
মফস্বলে পূজামণ্ডপ ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনায় বাঁশ, বেত, দড়ি, মাটি, খড় ইত্যাদি সম্মিলিত উদ্যোগেই বিভিন্ন বাড়ি থেকে প্রদান করা হয় এখনো। যারা প্রতিমাশিল্পী, তারাসহ পূজামণ্ডপ নির্মাণে অংশগ্রহণকারীদের খাবার ও আবাসন সুবিধাতেও সংশ্লিষ্ট সবাই সাধ্যমতো অবদান রেখে থাকেন।
ছাত্র-যুবাদের জন্য পূজার আয়োজন দলগত কার্যসম্পাদনের বাস্তব শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে। সমাজের সব মানুষের যৌথ প্রয়াস জন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন ঘটায়। তাই মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়।
শ্রীশ্রী চণ্ডীর কীলকস্তবে বিধৃত আছে—
ঐশ্বর্যং তৎপ্রসাদেন সৌভাগ্যারোগ্যমেব চ।
শত্রুহানি: পরো মোক্ষঃ স্তূয়তে সা ন কিং জনৈঃ ।। ১৩
[যদি দেবীর অনুগ্রহে ঐশ্বর্য, সৌভাগ্য ও আরোগ্য লাভ এবং শত্রুনাশ ও মুক্তিলাভ হয়ে থাকে, তবে লোকে সেই দেবীর স্তব করবে না কেন?]
সমাজের অভ্যন্তরে সৌহার্দ্য ও শুভবুদ্ধির মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় পূজার পরিসরে। এটি সামগ্রিক কল্যাণের আবহ সৃষ্টি করে। পারস্পরিক হৃদ্যতা ছোটখাটো বিবাদকে উপেক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সনাতনী সমাজে ‘দান’ আবশ্যক। পূর্বে গৃহী মানুষের দানকে অবলম্বন করেই অনেকে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন। প্রতিদিন আগন্তুককে ‘চাউল’ বা নিরন্নকে অন্নদান না করে সংসারী মানুষ অন্ন গ্রহণ করতেন না। কারণ সমাজের দুর্বল মানুষকে সহায়তা করাই হলো ‘নারায়ণ সেবা’। এই সেবাও ঈশ্বর উপাসনার অংশ। কালের পরিবর্তনে সমাজকাঠামোসহ জীবনযাত্রার রূপ ভিন্ন হয়েছে। কিন্তু সমর্থ পরিবারের এই দায় বিলুপ্ত হয়নি। ফলে গৃহী মানুষকে সাধ্যানুযায়ী অন্নদানের এই প্রয়াস দুর্গাপূজার সময়ে গ্রহণ করা যেতে পারে। দুর্গাপূজায় সাধারণত সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে সমবেত পূজারিদের অন্নপ্রসাদ বিতরণ করা হয়। এই প্রসাদ গ্রহণ পূজামণ্ডপে উপস্থিত সব পূজারি ও ভক্তদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। সামর্থ্যবান গৃহী মানুষ অন্নদানের এই মাহেন্দ্রক্ষণকে উপজীব্য করে প্রসাদ আয়োজনে তার সহায়তা প্রশস্ত করে রাখতে পারেন।
দুর্গাপূজা সমবেত আনন্দের উৎস। আবালবৃদ্ধবনিতার পারিবারিক সম্মিলন যা সামাজিক জমায়েতের স্নিগ্ধ রূপে উদ্ভাসিত হয়। সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগির জন্য আর্থিক সংগতিহীন মানুষের জন্য বস্ত্রের সংস্থান এই দুর্গাপূজায় করা হয়ে থাকে। গৃহী মানুষ তার সামর্থ্য অনুযায়ী নিজ পরিবারের প্রয়োজনীয় বস্ত্র সংগ্রহ করে সমাজের দুর্বল মানুষের জন্য সাধ্যমতো বস্ত্রদানে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
অন্ন, বস্ত্র ছাড়াও দরিদ্র পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তাদান ও সংগতিবান পরিবারের কর্তব্য। সমাজে এখন দুটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়ে অনেক পরিবার নাজুক অবস্থার সম্মুখীন হয়। এই দুটি প্রধানত শিক্ষা ও চিকিৎসায় ব্যয়। সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিবেশীর অসুবিধার সময়ে এগিয়ে আসা। দুর্গাপূজার অনেক আয়োজকরা এই জাতীয় সহায়তায় অংশগ্রহণ করে থাকেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এই দান? কেনইবা এতে অংশগ্রহণ করার আবশ্যকতা? শ্রীমদ্ভগবদগীতার শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগযোগে ভগবান বলেছেন—
দাতব্যমিতি যদ্দানং দীয়তেহনুপকারিণে।
দেশে কালে চ পাত্রে চ তদ্দানং সাত্ত্বিকং স্মৃতম।।২০
[“দান করা উচিত, তাই দান করি” এরূপ কর্তব্য বুদ্ধিতে উপযুক্ত দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করে অনুপকারী ব্যক্তিকে (অর্থাৎ প্রত্যুপকারের আশা না রেখে) যে দান করা হয় তাকে সাত্ত্বিক দান বলে।]
দুর্গাপূজার ব্যাপক আয়োজনে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে জগন্মাতা দেবী দুর্গার আরাধনা করার মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণে সবাইকে আবাহনের আমন্ত্রণের পথ উন্মুক্ত হয়। পূজা উপলক্ষে সমবেত পূজারিরা সমমর্যাদায় উপস্থিত থেকে দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করেন। পূজা অনুষ্ঠানের সময়ে ধর্মীয় আলোচনা আমাদের নৈতিকতাবোধে উজ্জীবিত করে।
সামাজিক সুশাসন ও দৈনন্দিন জীবনে ধর্মীয় নির্দেশনা শুভ ফলদায়ক ও সম্প্রীতি স্থাপনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
শ্রীশ্রী চণ্ডীতে ইন্দ্রাদিদেবতাগণ দ্বারা দেবীর স্তুতি নিম্নরূপ (বাংলায়):
ধ্যান
সিদ্ধিকামী পুরুষগণ সেবিতা, দেবগণ পরিবৃতা, জয়নামধারিণী দুর্গাদেবীর ধ্যান করবে। তার শ্রীঅঙ্গে বর্ণ কালো মেঘের মতো শ্যাম। তিনি কটাক্ষে শত্রুকুলত্রাসিনী। তিনি মস্তকে চন্দ্রকলাশোভিতা। চার হাতে শঙ্খ, চক্র, খড়্গ ও ত্রিশূল ধারণ করেন। তিনি ত্রিনয়না, সিংহোপরি অধিষ্ঠিতা এবং স্বীয় তেজে সমগ্র ত্রিভুবন পূর্ণকারিণী।
কল্যাণ্যৈ প্রণতাং বৃদ্ব্যৈ সিদ্ধ্যৈ কুর্মো নমো নমঃ।
নৈর্ঋত্যৈ ভুভৃতাং লক্ষ্ণ্যৈ শর্বাণ্যে তে নমো নমঃ।।
(শ্রী শ্রী চণ্ডী ৫/১১)
শরণাগতের কল্যাণকারিণী, বৃদ্ধি এবং সিদ্ধিরূপা দেবীকে বারবার প্রণাম করি। নৈর্ঋতী, রাজাদের লক্ষ্মী তথা শর্বাণী স্বরূপা জগদম্বা আপনাকে বারবার প্রণাম।
শ্রীশ্রী চণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ে নারায়ণী স্তুতি বর্ণিত হয়েছে। দেবতারা এই স্তুতি নিবেদন করেন।
প্রণতানাং প্রসীদ ত্বং দেবী বিশ্বার্তিহারিণী।
ত্রৈলোক্যবাসিনামীড্যে লোকানাং বরদা ভব।।৩৫
হে জগতের দুঃখনাশিনী দেবী। আমরা আপনার চরণে প্রণত। আমাদের প্রতি প্রসন্না হোন। ত্রিভুবনবাসীর আরাধ্যা পরমেশ্বরী। আপনি আমাদের বরদান করুন।
উত্তরে দেবী স্তুতি নিবেদনকারী দেবতাদের বর প্রার্থনার অনুমতি প্রদান করেন। (শ্লোক ৩৬-৩৭)
দেবতাগণ বললেন, হে অখিলেশ্বরী! আপনি এখন যেমন ত্রিভুবনের সমস্ত বিঘ্নের প্রশমন করলেন, ভবিষ্যতেও আমাদের শত্রুকুল বিনাশ করবেন।
দেবী উত্তর দিলেন—হে দেবগণ! যৈবশ্বত মনুর অধিকারসময়ে অষ্টবিংশতিযুগে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে অন্য দুই অসুর জন্মাবে। (৪০-৪১)
তখন আমি নন্দগোপের ঘরে তার পত্নী যশোদার গর্ভে অবতীর্ণ হয়ে বিন্ধ্যাচলে গিয়ে বাস করব। আর এই দুই মহাসুরকে বিনাশ করব।(৪২)
ভূয়শ্চ শতবার্ষিক্যামনাবৃষ্টামনন্তসি।
মুনিভি: সংস্তুতা ভূমৌ সম্ভবিষ্যাম্যযোনিজা। (৪৬)
তারপর আবার যখন পৃথিবীতে একশ বছর ধরে অনাবৃষ্টি হবে এবং পৃথিবীতে জলাভাব হবে, তখন মুনিগণ আমার স্তব করলে আমি পৃথিবীতে আবির্ভূত হব। (শ্লোক: ৪৬)
শ্লোক: ৪৮-এ দেবী উল্লেখ করলেন, হে দেবগণ! সেই সময় আমি নিজের শরীর থেকে উৎপন্ন হওয়া প্রাণধারক শাকপাতা দ্বারা সমগ্র জগতের ভরণপোষণ করব। যতদিন পর্যন্ত বৃষ্টি না হবে, ততদিন ওই শাকই সমস্ত প্রাণীদের রক্ষা করবে। শ্লোক: ৪৯-এ দেবী বলেন, এই কাজের জন্য পৃথিবীতে আমি শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হব। ওই অবতারেই আমি দুর্গম নামে মহাসুরকে বধ করব। (শ্লোক: ৪৯)
দুর্গাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি।
পুনশ্চাহং যদা ভীমং রূপং কৃত্বা হিমাচলে।। ৫০
রক্ষাংসি ভক্ষয়িষ্যামি মুনীনাং ত্রাণকারণাৎ।
তদা মাং মুনয়ঃ সর্বে স্তোষ্যন্ত্যানম্রমূর্তয়ঃ।।৫১
এর ফলে আমি দুর্গাদেবী নামে বিখ্যাত হব। তারপর আমি যখন ভীমরূপ ধারণ করে মুনিদের রক্ষার জন্য হিমালয়নিবাসী রাক্ষসদের ভক্ষণ করব, তখন মুনিরা সকলে ভক্তিতে প্রণত মস্তকে আমার স্তুতি করবেন। (শ্লোক ৫০-৫১)
ওপরে বর্ণিত শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থের শ্লোকসমূহ পর্যালেচানায় দেখা যায়, দেবী দুর্গা বিশ্বত্রাণ ও বিশ্বকল্যাণের জন্য দেবতাদের বর প্রদান করেছেন। তিনি শুধু শত্রুসংহারে আশ্বস্ত করেননি। তিনি খাদ্যাভাব, জলাভাব ইত্যাদি দুর্ভোগ-দুর্যোগ নিরসনে নিজ উদ্যোগে তা নিরসনের কথা ব্যক্ত করেছেন। তার এই আশ্বাস নিজেদের মননে ধারণে আমরা যদি শক্তিসঞ্চারে সমর্থ হই তবে পার্থিব কল্যাণ তথা দেশজ ও সমাজকল্যাণ সমৃদ্ধ হতে বাধ্য।
সমাজকল্যাণের এই ধারণাকে সাংবাৎসরিক মহাপূজা ‘দুর্গাপূজা’য় বেগবান করার কৌশল অনুসন্ধান করে তা বাস্তবায়নে অগ্রসর হলে সমাজকল্যাণ তথা সনাতনী ও দেশজ উন্নয়নে বড় অবদান রাখা সম্ভব হবে।
ওঁ শান্তি। ওঁ শান্তি।। ওঁ শান্তি।।।
লেখক: ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির কমিটির উপদেষ্টা পুরোহিত; সম্পাদক জয় বাবা লোকনাথ পঞ্জিকা এবং অতিরিক্ত সচিব (অব.)