প্রযুক্তির যুগে বড়দের পাশাপাশি সোনামণিদের হাতে গ্যাজেট চলে এসেছে! অভিভাবকরা সন্তানকে শান্ত রাখতে, কোনো কিছু খাওয়াতে কিংবা সময় কাটাতে তার হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাব তুলে দেন। স্মার্ট টেলিভিশনে গান, কার্টুন বা মজার ভিডিও চালিয়ে সন্তানকে শান্ত রাখার প্রবণতা এখন ঘরে ঘরে। ফলে ডিজিটাল স্ক্রিনে এখন শিশুদের অবাধ বিচরণ। দিনের অনেকটা সময় গ্যাজেটে ডুবে থাকার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের অভ্যাস জন্ম নেয়। একবার এটি পেয়ে বসলে ছাড়ানো বেশ কঠিন। ডিজিটাল স্ক্রিন থেকে শিশুদের দূরে রাখার প্রয়োজনীয়তা ও নিয়মাবলি জেনে নিন। লিখেছেন—বৃষ্টি শেখ খাদিজা
বাবার অফিসে ঘুরতে এসেছে আট বছর বয়সী দানিয়েল। হঠাৎ ভিডিও কল করেন তার চাচা। দানিয়েলকে চাচার সঙ্গে কথা বলতে ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু সেদিকে খেয়াল না করে কম্পিউটার গেমসে ডুবে আছে ছোট্ট দানিয়েল। নিজেদের শিশুসন্তানকে নিয়ে হরহামেশাই এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়ে থাকেন বাবা-মা। স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবসহ বিভিন্ন গ্যাজেটে শিশুরা দিনের অনেকটা সময় কাটায়। কিন্তু এ অভ্যাস তাদের বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশুদের স্থূলতা বৃদ্ধির কারণ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় এটি।
আরেকটি ঘটনা। সকাল থেকেই বড্ড ঘ্যান ঘ্যান করছিল আড়াই বছর বয়সী সোহা। এদিকে তার মায়ের হাতে অনেক কাজ। তাই বাধ্য হয়ে তিনি নিজের স্মার্টফোন ধরিয়ে দিলেন মেয়েটার হাতে। ফোন পাওয়া মাত্রই দুষ্টু মেয়ে চুপ! আর মা ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই নিজের কাজ সারতে থাকেন। এমন ঘটনা অনেকের দৈনন্দিন জীবনে প্রায়ই ঘটে। জানেন কি, এভাবে বাচ্চাদের হাতে স্মার্টফোন দিয়ে তার ক্ষতি হচ্ছে? এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু দিনের প্রায় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা স্মার্টফোন নিয়ে কাটায়, তাদের বুদ্ধির বিকাশ অন্য বাচ্চাদের তুলনায় অনেক কম হয়।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এখন প্রায় ৯০ ভাগ মা কর্মস্থলে কিংবা উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যস্ত থাকেন। তাই বাচ্চাকে দেওয়ার মতো সময় তাদের হাতে প্রায় থাকে না বললেই চলে। এ কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে শিশুদের হাতে স্মার্টফোন ধরিয়ে দেন অভিভাবকরা। অনেকে বাচ্চার জন্য আলাদা করে ট্যাব বা স্মার্টফোন কিনে রাখেন। যাতে খাওয়ার সময় গ্যাজেটে কার্টুন বা গানের ভিডিও দেখতে দেখতে শিশুটি অনায়াসে খেয়ে নেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের এভাবে ভুলিয়ে রাখতে গিয়ে অভিভাবকরা বিরাট ক্ষতি করছেন। প্রতিদিন স্মার্টফোন ব্যবহার করলে শিশুদের কল্পনাশক্তি ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। এমনকি অনেক শিশুর মধ্যে বেশি খাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়, যা থেকে অল্প বয়েসেই তারা স্থূলতার সমস্যায় ভোগে। এ ছাড়া দিনের অনেকটা সময় ডিজিটাল স্ক্রিনে তাকানোর কারণে শিশুর দৃষ্টিশক্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে অল্প বয়সেই তাদের চোখে সমস্যা দেখা দেয়।
২০০৯-২০১২ সালে দুই থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের ওপর এক গবেষণায় জানা যায়, দিনে দুই ঘণ্টার বেশি টিভি দেখলে শিশুদের স্থূল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আরেক গবেষণার তথ্যমতে, ৯-১০ বছর বয়সী শিশুদের যারা তিন ঘণ্টা টিভি বা স্মার্টফোন দেখে, তাদের মাঝে স্থূলতা বেশি। এ ধরনের ১৪টি গবেষণার ফল একসঙ্গে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, টিভি ও স্মার্টফোনে শিশুর সময় কাটানোর পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে স্থূলতা বাড়ে সমান অনুপাতে। প্রতি এক ঘণ্টা বাড়তি টিভি দেখলে শিশুর ওজন বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি ১৩ শতাংশ।
শিশুর খাদ্যাভ্যাসের ওপর স্ক্রিনটাইমের প্রভাব অনুসন্ধান করেছে এমন ২২টি গবেষণার ফল একসঙ্গে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শিশুর উচ্চ ক্যালরিযুক্ত ও অস্বাস্থ্যকর জাঙ্ক খাবার প্রীতির সম্ভাব্য কারণ স্মার্টফোন বা টেলিভিশনে দেওয়া বিভিন্ন বিজ্ঞাপন। স্ক্রিনে বেশি সময় কাটানোর কারণে শিশুরা বিজ্ঞাপনও বেশি দেখে। শিশুদের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বানানো হয় শত শত খাদ্যের বিজ্ঞাপন, যা শিশুদের সেসব খাবারের প্রতি আকৃষ্ট করে। এ থেকেই দেখা দেয় স্থূলতার মতো জটিল সমস্যা।
শিশুদের মাত্রাতিরিক্ত সময় স্ক্রিনে কাটানোর নেতিবাচক পরিণতি নিয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মা-বাবা কিংবা অভিভাবকরা কয়েকটি পন্থা বেছে নিতে পারেন।
১. শিশুরা বড়দের দেখেই শেখে। অভিভাবকরা ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, টেলিভিশনে কম সময় দিলে শিশুরাও সেসবে থাকার আগ্রহ
পাবে না।
২. শিশুদের সঙ্গে খেলা, বই পড়ে শোনানো, গল্প করাসহ নানাভাবে আনন্দের সঙ্গে সময় কাটানো যায়। মা-বাবা যখন শিশুদের সময় দেবেন, তখন যেন তারা সম্পূর্ণ মনোযোগ পায়। ফোনে চোখ রেখে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এক ধরনের অবহেলা; যা শিশুদের বিকাশে সহায়ক নয়।
৩. একবার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেলে সেটা পরিবর্তন করা কঠিন। শুরু থেকেই শিশুদের গ্যাজেটের পরিমিত ব্যবহার শেখাতে হবে।
৪. স্ক্রিনে বেশিক্ষণ থাকা শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অল্পবয়সী
শিশুদের স্ক্রিনে কিছু দেখানোর সময় তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে; তাদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত
করা প্রয়োজন। এটি তাদের যে কোনো কিছু শেখার বেলায় ভূমিকা রাখবে।
৫. নাচ, সাঁতার, জিমন্যাস্টিকস, সংগীত বা শিশুর পছন্দের কিছু শেখানোর ব্যবস্থা করতে পারেন। নিজেই করা যায় এমন কাজ শিশুকে করতে শেখাতে পারেন। তাদের কোনো সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখুন। এটি তাদের অবসর সময়গুলোতে ব্যস্ত এবং উৎপাদনশীল রাখবে, যা তার মেধা বিকাশেও কাজ করবে।
৬. পুরো পরিবারের একসঙ্গে অন্তত রাতের বেলা সময় কাটানোর ব্যবস্থা করুন। হতে পারে তা মজার কোনো খেলা, মজার গল্প বলা বা নিছকই আড্ডা দেওয়া। সবাইকে নিয়ে সময় কাটান। শিশুদের সৃজনশীল কিছু করার জন্য বলতে পারেন। তারা আবৃত্তি শোনাতে পারে কিংবা গান গেয়ে শোনাতে পারে। বড়রাও তাদের সঙ্গে অংশ নিতে পারেন। পরিবারের সবার সঙ্গে আনন্দময় স্মৃতি তৈরি করার বিকল্প নেই। এটি শিশুকে একজন হাসিখুশি আর ইতিবাচক মানুষ হিসেবে তৈরি করবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ বিভাগের কর্মকর্তা হুয়ানা উইলামসেন বলেন, ‘শিশুদের জীবনে খেলাধুলা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিতের পাশাপাশি নিষ্ক্রিয় সময়কে খেলাধুলার সময়ে রূপান্তরিত করতে হবে।’
শিশুদের স্মার্টফোন-আসক্তির ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতন হওয়া এবং এর প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। মা-বাবাকে নিজের ও সন্তানের স্ক্রিনে কাটানো সময় নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে সবচেয়ে বেশি। শিশুরা যাতে আনন্দের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে, সেজন্য খেলাধুলা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে উৎসাহ দেওয়া ভালো। এতে তাদের পরিপূর্ণ বিকাশ হয়। স্ক্রিনে ডুবে থাকা আর না, আর না!