আজ বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০০টি দেশে কুষ্ঠ রোগের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এই দিবস পালন করা হয়। কুষ্ঠ একটি জীবাণুবাহিত সংক্রামণ। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত এবং উপযুক্ত চিকিৎসায় এই রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব। বিস্তারিত জানাচ্ছেন ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
১৩টি আন্তর্জাতিক এনজিওর সমন্বয়ে গঠিত সুইজারল্যান্ডভিত্তিক কুষ্ঠবিরোধী আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ‘আইলেপ’ বিশ্বব্যাপী কুষ্ঠ দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়। কুষ্ঠজনিত কুসংস্কার দূরীকরণ, কুষ্ঠ আক্রান্তদের সাহায্য করা এবং জনবিচ্ছিন্ন কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমাজে পুনঃগ্রহণের জন্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ১৯৫৪ সালে দিবসটি উদযাপনের জন্য উদ্যোগ নেয় সংগঠনটি।
১৮৭৩ সালে নরওয়ের বিজ্ঞানী গেরহার্ড হ্যানসেন জানান, কুষ্ঠ একটি জীবাণুঘটিত রোগ। খুব ধীরে বংশ বিস্তার করা ব্যাকটেরিয়া মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রে নামে পরিচিত। তাই রোগটিও হ্যানসেনস ডিজিজ নামে পরিচিতি লাভ করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, প্রতি লাখে পাঁচজন বা তার অধিক কুষ্ঠ রোগী পাওয়া গেলে তাকে উচ্চঝুঁকি বলতে হবে। প্রতি ১০ হাজার জনগোষ্ঠীর মধ্যে নথিভুক্ত কুষ্ঠ রোগীর হার একজনের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে। ২০২০ সালে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ৭১৯ জন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে কুষ্ঠমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে।
কুষ্ঠ রোগের লক্ষণ
বাচ্চা থেকে বয়স্ক, যে কোনো বয়সের ব্যক্তি এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কুষ্ঠ রোগ হাতের চামড়ায় প্রথমে দেখা দেয়। কুষ্ঠ রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো হলো, ত্বকের রং পরিবর্তন, ফ্যাকাশে দাগ এবং ছোপযুক্ত ত্বক। ত্বকের ওপর জ্বালা-যন্ত্রণা অনুভব হয় এবং প্রচণ্ড গরম লাগে। মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। হাত ও পায়ে ঘা এবং অসাড় হয়ে যায়। ত্বক রুক্ষ ও শুষ্ক এবং চুল উঠে যেতে থাকে। নাক বন্ধ এবং নাক দিয়ে রক্ত পড়তে পারে।
জটিলতা
সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে কুষ্ঠ রোগের কারণে দৈহিক বিকৃতি, বন্ধ্যত্ব, লেপ্রাফিভার, দেহের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রগুলোর ক্রিয়া বিকৃতি হতে পারে। এ ছাড়া শ্বাসকষ্ট, বারবার মূর্ছাভাব এবং নাক দিয়ে রক্ত পড়া কিংবা অনুভূতি শক্তি হ্রাসের মতো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। চিকিৎসা কেন্দ্রে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা দ্বারা এই রোগ চিহ্নিত হলে উপযুক্ত চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
কীভাবে ছড়ায়
আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি, থুতু, লালা, নাক থেকে নিঃসৃত পানি ইত্যাদির দ্বারা। রোগীর সঙ্গে হাত মেলালে বা কোলাকুলি করলে, পাশাপাশি বসলে বা বসে থাকলে এবং পাশাপাশি বসে খাওয়া-দাওয়া করলে কুষ্ঠ সংক্রমিত হওয়ার ভয় নেই। বাইরে চলাফেরার সময় স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলা অতি উত্তম। হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা সবার জন্যই নিরাপদ। হাত না ধুয়ে কোনো খাবার না খাওয়া। বাইরের পানি বা পানীয় পান না করা। আক্রান্ত ব্যাক্তিরও সচেতনতা জরুরি। রোগ নিশ্চিত হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
চিকিৎসা
বর্তমানে দেশের প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এসব হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের জন্য জীবাণু নিরূপণ, স্কিন বায়োপ্সি, নার্ভ বায়োপ্সি ও অন্যান্য ইমিউনোলজিক্যাল পরীক্ষারও ব্যবস্থা আছে। মাল্টি ড্রাগ থেরাপি (এমডিটি) চিকিৎসায় কুষ্ঠ থেকে পুরোপুরি সেরে ওঠা সম্ভব। কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলো বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদি নিয়মিত চিকিৎসায় কুষ্ঠ সম্পূর্ণ নিরাময় হয়। সেজন্য রোগী ও পরিবারের সবাইকে ধৈর্য নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি