
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি ১০০ শিশুর ৩ থেকে ৬ জন বড় ধরনের জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। শিশুমৃত্যুর চতুর্থ কারণ হিসেবে জন্মগত ত্রুটিকে বিবেচনা করা হয়। বিস্তারিত জানাচ্ছেন ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
জন্মগত ত্রুটি সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষের স্বচ্ছ ধারণা নেই। বেশিরভাগ সময় শিশুর জন্মগত ত্রুটির জন্য প্রসূতি মাকে দোষারোপ করা হয়। অনেকে এর কারণ হিসেবে গর্ভকালীন সূর্যগ্রহণ/চন্দ্রগ্রহণের প্রভাব, খাবার খাওয়ার ফল, মানুষের কুনজর, জিন-পরির আসরকে দায়ী মনে করে। তবে এখন পর্যন্ত জন্মগত ত্রুটি সম্পর্কে যেসব কারণ জানা গেছে, তার মধ্যে রয়েছে বংশগত, জিনগত, রক্তসম্পর্কীয় বিয়ে, খুব কম বা বেশি বয়সে সন্তান ধারণ, অপুষ্টি, গর্ভকালীন ধূমপান ও মদ্যপান, বিভিন্ন সংক্রামক রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হরমোনজনিত সমস্যা, খিঁচুনি, অপচিকিৎসা, তেজস্ক্রিয়তা, ভেজাল খাদ্যদ্রব্য, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ সেবন ইত্যাদি।
বিভিন্ন কারণে শিশু জন্মের সময় ত্রুটিযুক্ত হতে পারে। শরীরের গঠনগত, কার্যগত, মেটাবলিক বা জেনেটিক অসামঞ্জস্য এর কারণ, যা ভ্রূণ অবস্থাতেই তৈরি হয়। শিশুর বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—ঠোঁট কাটা, তালু কাটা, হাতের আঙুল বেশি থাকা, আঙুল একসঙ্গে লেগে থাকা ইত্যাদি।
জন্মের পর চোখে বা মুখে শিশুর একটি কালো লাল দাগ থাকতে পারে। সাধারণত মুখে খুব বেশি হয়। অনেকে ভাবে পিঁপড়া অথবা মশার কামড়। আস্তে আস্তে এটি দাগ হয়ে যায়। একে বলা হয় হেমানজিওমা। আবার শরীরে কোথাও একটি ছোট কালো দাগ, তিলের মতো থাকতে পারে। পরে দেখা যায় ওটা বড় হচ্ছে। একে বলা হয় কনজেনিটাল নিভাস।
আবার অনেক সময় দেখা যায় একটি হাতের আঙুল বা দুটি হাতের আঙুল একটু বড় মনে হচ্ছে। চার থেকে পাঁচ দিন পর হঠাৎ এটি বড় হতে শুরু করে। একে লিম্ফেনজিওমা বলে। আবার হতে পারে নিউরোফাইব্রোমা। এতে হাতের আঙুলগুলো বড় হতে পারে। একটি পুরো হাত বড় হতে পারে অথবা দেখা যায় মুখের একটি অংশ ঝুলে আছে। একে বলা হয় নিউরোফাইব্রোমা।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, জন্মগত ত্রুটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা; কিন্তু এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায় মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোয়।
পৃথিবীতে প্রায় চার হাজারের বেশি রকমের জন্মগত ত্রুটি রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৩৩ শিশুর একজন জন্মগত ত্রুটি নিয়ে পৃথিবীতে আসে।
এক্ষেত্রে স্বল্প আয়ের দেশগুলোর মায়েদের পুষ্টিহীনতা, দারিদ্র্য, আত্মীয়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক, জিনগত ও বংশানুক্রমিক রোগের কারণগুলো দায়ী করা হয়।
জন্মগত ত্রুটিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। কাঠামোগত ত্রুটি অর্থাৎ কোনো অঙ্গ জন্ম থেকেই অস্বাভাবিক, অকেজো, অসম্পূর্ণ। যেমন : হৃৎপিণ্ডের সমস্যা। অন্যটি হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় অকার্যকারিতা। এ কারণে যেসব জন্মগত ত্রুটি হয়ে থাকে তা হলো, খাদ্যরস পাচিত না হওয়ার কারণে বিপাকীয় সমস্যা, বুদ্ধিবৃত্তির অনুন্নতি, বধির, দৃষ্টিস্বল্পতা ইত্যাদি।
জন্মগত ত্রুটির বিষয়ে সচেতন হতে এবং শুরুতেই প্রতিরোধ বা চিকিৎসার জন্য গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই সাবধান হতে হবে। এ জন্য নিম্নলিখিত বিষয়ে লক্ষ রাখুন।
রক্তের সম্পর্কের কাউকে বিয়ে না করাই ভালো।
২০ বছরের কম এবং ৪০ বছরের পর গর্ভধারণ করা উচিত নয়।
বিয়ের আগেই পাত্র-পাত্রীর রক্ত পরীক্ষা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্মঝুঁকি বিষয়ে জানা সম্ভব।
গর্ভধারণের আগেই মা-বাবার পূর্ব ইতিহাস জেনে শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি নির্ণয় ও প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
ভ্রূণের প্রথম ১২ থেকে ২২ সপ্তাহে ‘হাইরেজল্যুশন আল্ট্রাসনোগ্রামের’ মাধ্যমে বেশিরভাগ ত্রুটি বোঝা যেতে পারে। তাই এ সময়ে গর্ভবতীদের ‘অ্যানোমালি স্ক্যানিং’ করানো উচিত।
জিনগত সমস্যা শনাক্ত করতে রক্ত পরীক্ষা এবং ‘অ্যামনিওটিক ফ্লুইড অ্যানালাইসিস’, ‘কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পল অ্যানালাইসিস’ ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখন বাংলাদেশেই সম্ভব।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি