রীতা ভৌমিক
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৪, ০২:৫৩ এএম
আপডেট : ৩০ জুন ২০২৪, ০৮:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

উত্ত্যক্তকরণের প্রভাব পড়ছে কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্যে

উত্ত্যক্তকরণের প্রভাব পড়ছে কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্যে

পথঘাটে চলাচলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে উত্ত্যক্তের শিকার হয় মেয়ে শিশু, কিশোরী কিংবা তরুণীরা। কারও কারও ক্ষেত্রে ঘটে যৌন হয়রানির ঘটনা। এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। দিনের পর দিন এ সমস্যার কারণে অনেক শিশুর বেড়ে ওঠা বিঘ্নিত হয়। লিখেছেন রীতা ভৌমিক

অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী অন্তরা। চৌদ্দ বছর বয়সে সে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হয়। স্কুলে কোনো প্রতিযোগিতায় ভালো না করলে সহপাঠীরা ওকে লুজার লুজার বলে সম্বোধন করত। সহপাঠীদের আচরণে মন খারাপ করে একমনে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকত। লেখাপড়ায় অমনোযোগিতার কারণে শিক্ষকরাও ওকে কটূক্তি করতেন। এভাবে ওকে বাইরে তাকাতে দেখে একদিন শিক্ষক ওকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘বাইরে কার দিকে তাকাচ্ছ? রিকশাওয়ালা ছাড়া আর কাউকে তো দেখতে পারছি না।’ বাড়িতে অভিভাবকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো খোলামেলা কথা বলত না ও। দিনের পর দিন এ ধরনের মন্তব্য শুনতে শুনতে ও অন্তর্মুখী স্বভাবের হয়ে যায়। সবকিছু থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলে। কারও সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগত না ওর। কেউ ওকে বুঝতে চাইত না।

অন্তরা (ছদ্মনাম) বলে, বন্ধু ও শিক্ষকদের এ ধরনের কটূক্তি শুনতে শুনতে স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছেটা চলে যায়। একসময় স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিই। নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলি। পরিবারের সদস্যদের থেকেও নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। ঘর থেকে বের হতাম না। বাবা-মা আমাকে একজন মনোবিজ্ঞানীর কাছে নিয়ে যান। তিনি আমার সঙ্গে অনেক কথা বলেন, আমাকে আমার গুরুত্ব বোঝান।

অন্তরার মা জানালেন, ও যখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল, ভয় পেয়ে গেলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম, মেয়েটার কী হলো। কেন এমন করছে। ওকে একজন মনোবিজ্ঞানীর কাছে নিয়ে গেলাম। ও চারটি সেশন করল। ধীরে ধীরে ওর সমস্যাগুলো উনার সঙ্গে শেয়ার করতে থাকে। সব কথা উনি অবশ্য আমাদের সঙ্গেও শেয়ার করেননি। তবে ওকে আমরা এখন সময় দিই। আমাদের সঙ্গেও কিছু কিছু কথা শেয়ার করতে থাকে। এভাবে ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। নবম শ্রেণিতে ওই স্কুলে আবার ভর্তি হয়। এখন লেখাপড়ায় মনোযোগী হয়েছে। সপরিবারে আমরা এখন বেড়াতে যাই, সময় কাটাই। ওর কাজিনদের সঙ্গেও বেড়াতে যায়। নিজেকে গুটিয়ে রাখা থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসছে। এখন পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে শিখেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজির সহকারী অধ্যাপক রউফান নাহার বলেন, উত্ত্যক্তকরণ বা যৌন হয়রানি একজন কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়ে। সে আবেগীয় এবং সামাজিকভাবে অনিরাপত্তার মধ্যে পড়ে যায়। রাস্তাঘাট, স্কুল, বাসা বিভিন্ন স্থানে উত্ত্যক্তকরণের শিকার হওয়ায় তার ভেতর মানসিক ট্রমার সৃষ্টি হয়। মানসিক ক্ষতের কারণে তার আত্মবিশ্বাস কমে যায়। উত্ত্যক্তকরণে তার দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত হয়। মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশকে বিঘ্নিত করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, যে শিশু উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয় না সে উচ্ছলতা, স্বাভাবিকতায় প্রাণবন্ত থাকে। আর যে উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়, তার ভেতর জড়তাগ্রস্ত থাকে। এর মাত্রা নির্ভর করে বেশিমাত্রায় উত্ত্যক্তের শিকার হলে যারা চুপচাপ, অন্তর্মুখী স্বভাবের তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেহেতু তারা তাদের সমস্যার কথা প্রকাশ করতে পারে না। যারা প্রকাশ করতে পারে তারা তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যারা পারিবারিক এবং সামাজিক সহযোগিতা বেশি পায়, তারা সমস্যা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারে। যারা অভিভাবক, শিক্ষক, সমাজ থেকে সেই সহযোগিতা পায় না, তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক তথ্যে জানা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ৮৪ জন। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৪৯ জন। উত্ত্যক্তকরণের পর আত্মহত্যা করেছে ৯ জন।

২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৩৮ জন উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ৬৪ জন। মে মাসে শূন্য থেকে ১৮ বছরের উত্ত্যক্তকরণের পর আত্মহত্যা করেছে একজন।

এর মধ্যে শূন্য থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ২২ জন, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ৪৯ জন। ১৮ বছরের পরে উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ১৬ জন, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৫ জন।

জানুয়ারিতে শূন্য থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে তিন, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে একজন। ১৮ বছরের পরে উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে দুই এবং নিপীড়নের শিকার হয়েছে তিনজন।

ফেব্রুয়ারিতে শূন্য থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে চার, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১১ জন। ১৮ বছরের পরে উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ১১ এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে পরে পাঁচজন।

মার্চ মাসে শূন্য থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ৯, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১০ জন। ১৮ বছরের পর উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে এক এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে দুজন।

এপ্রিল মাসে শূন্য থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে এক, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে পাঁচজন। ১৮ বছরের পরে উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে এক এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে চারজন।

মে মাসে শূন্য থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে পাঁচ, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ২২ জন। ১৮ বছরের পর উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে এক এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে একজন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানি যে একটি অপরাধ, কিছুটা প্রকাশ হলেও তা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখানেও একটি সামাজিক সচেতনতার দরকার রয়েছে। এখানে গণমাধ্যমের একটি ভূমিকা রয়েছে।

তিনি বলেন, এটি প্রতিরোধ করতে হলে উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানি যে অপরাধ, তা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পরিবার, সমাজ, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের সচেতন করাটা জরুরি। হাইকোর্টের নির্দেশ আছে, সাক্ষী আছে, কিন্তু বিচার ব্যবস্থার কাছে এটিকে অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারায় কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেই।

অন্যদিকে তিনি বলেন, অপরাধের শাস্তি হওয়া দরকার। সেটাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কারণ যারা ক্ষমতায় আছেন, যারা জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক ক্ষমতায় যারা তারা সামাজিকভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তি। এসব কারণেও ভিকটিম সত্যি কথাটি বলতে সাহস পায় না। সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে এর সুরাহার অগ্রগতি হবে না। মূল কথা, ভিকটিমের লড়াই করার মনোবল থাকতে হবে। কারণ তাকে মনে রাখতে হবে, সে কোনো অন্যায় করেনি। তার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। এই অন্যায়ের বিচার সে চায়। এক্ষেত্রে নারী-শিশু, মানবাধিকার সংগঠন, গণমাধ্যমকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানির শিকার শিশু, কিশোরী, নারীদের মনোবল বাড়াতে হবে। এর বিচার পাওয়া যে তার ন্যায়সংগত অধিকার এই মেসেজ তাকে দিতে হবে। এ ঘটনার যাতে যথাযথ বিচার হয় আইন সহায়তাকারী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া তাদের মনো চিকিৎসায় সহায়তা করা। এ ঘটনা তার জীবনধারায় যেন কোনো অভিঘাত করতে না পারে সেটাকে গুরুত্ব দেওয়া। তার পারিবারিক জীবন, লেখাপড়া যেন বাধাগ্রস্ত না হয় তা দেখা। এজন্য এলাকায় এলাকায় শিশু-কিশোর সংগঠন, নারী-মানবাধিকার সংগঠন গড়ে তোলা। তাদের জন্য নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করা, পাঠাগার, ক্লাব গড়ে তোলা।

ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ভিকটিমকে মানসিক সাপোর্ট যারা দিচ্ছেন তাদের ঢালাও ধারণা রয়েছে। এ থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালে কী ধরনের মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে এজন্য তাদেরও প্রশিক্ষণ দরকার। কারণ একেকটি ট্রমায় একেকরকম সাইকোলজি কাউন্সেলিং দরকার।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি বলেছেন, নারী-শিশু-কিশোরীকে উত্ত্যক্তকরণ এবং যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ করা আমাদের একটি বড় এজেন্ডা। কিশোরী নারীকে স্বাধীনভাবে নিরাপদ চলাফেরার অবস্থান তৈরি করে দেওয়া সরকারেরও অঙ্গীকার রয়েছে। এ নিয়ে কাজ চলমান রয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নায্য পেনাল্টি দেওয়া হয়নি ব্রাজিলকে, কনমেবলের ভুল স্বীকার

সিনিয়র ক্রিকেটারদের কারণেই পাকিস্তানে পরিবর্তন সম্ভব নয়!

কোয়ার্টার ফাইনালেই ক্রুসকে অবসরে পাঠাতে চায় স্পেন

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা মিথ্যা : বরকত উল্লাহ বুলু

মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের জন্য এনআইডি কার্যক্রম বিষয়ক মতবিনিময় সভা

অপুকে ছাগলের বাচ্চার সঙ্গে তুলনা করলেন বুবলী

উইম্বলডন ২০২৪ / দ্বিতীয় রাউন্ডে জোকোভিচ, ভন্দ্রোসোভার বিদায়

আওয়ামী লীগ নয়, জিয়া, খালেদা, এরশাদ দেশ বিক্রি করেছেন : প্রধানমন্ত্রী

ফল উৎসব আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ : আব্দুস সালাম 

সমুদ্রসম্পদ আহরণে সব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে : বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী

১০

এমপি আনার হত্যা, যেভাবে পালিয়ে যান ফয়সাল

১১

নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দুই কোরিয়ার

১২

যমুনার গর্ভে বিলীন ৫ শতাধিক বাড়িঘর

১৩

প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফরে উন্নয়ন ইস্যু প্রাধান্য পাবে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

১৪

মুম্বাইয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রোহিতদের সংবর্ধনা

১৫

এমপি আনার হত্যা : এবার ফয়সালের দোষ স্বীকার

১৬

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী

১৭

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার পরিকল্পনা নেই : জনপ্রশাসনমন্ত্রী

১৮

দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়েছে সরকার : নিতাই রায়

১৯

সুনীল অর্থনীতিকে মূল অর্থনীতিতে কাজে লাগাতে হবে : প্রতিমন্ত্রী

২০
X