দাউদাউ আগুন জ্বলছে। বাড়িঘর, দোকান-দালান জ্বালিয়ে সেই আগুনের লেলিহান শিখা উড়তে থাকে সরু গলিতেও। ভয়ংকর এক রাতের আগুন প্রাণ কেড়ে নেয় নারী-শিশুসহ ১২৪ জনের। দগ্ধ হন আরও অনেকে। ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে পুরান ঢাকার নিমতলী এলাকায় ঘটে এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।
কেমিক্যাল গুদাম থেকে সৃষ্ট সেই ট্র্যাজেডির পর পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গুদাম-দোকান সরানোর তোড়জোড় শুরু হয়। বাসযোগ্য এলাকা গড়তে আসে নানা প্রতিশ্রুতি। কিন্তু গত ১৩ বছরেও সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। ভয়ংকর কেমিক্যালে ঠাসা গুদাম-দোকানের এলাকায় মৃত্যু হাতে নিয়েই বসবাস করছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। এমন পরিস্থিতিতে ফের সামনে এসেছে ভয়ংকর ৩ জুন। ওই ট্র্যাজেডিতে হতাহতদের কয়েক স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিনটি স্মরণে আজ নিমতলী মোড়ে স্থাপিত ‘স্মৃতিসৌধে’ ফুল দিয়ে নিহতদের স্মরণ করবেন তারা।
নিমতলীর মোড়ে ছোট্ট ফলের দোকান করতেন মামুন মিয়া। ওই ট্র্যাজেডিতে চোখের সামনে পুড়ে মারা যায় তার সাত বছরের ছোট্ট সন্তান বৈশাখ। মামুন মিয়াও হন দগ্ধ। তিনি এখনো সেই দোকানটাতে ফল বিক্রি করেন। গতকাল নিমতলী মোড়ে কথা হয় স্থানীয় কয়েক বাসিন্দার সঙ্গে। ট্র্যাজেডিতে তাদের অনেকেই স্বজন হারিয়েছেন। সেই ভয়াবহ রাতের কথা জানতে চাইলে তারা ক্ষুব্ধ হন। তারা বলছিলেন, স্বজন হারালেও মৃত্যুঝুঁকি তাদের পিছু ছাড়েনি। বছরের পর বছর ধরে তারা এ ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করছেন। প্রভাবশালীরা এখনো বাসাবাড়িতে রাসায়নিকের গুদাম বানিয়ে রেখেছেন।
ইসমাইল হোসেন নামে এক বাসিন্দা বলছিলেন, আগুন লাগার পর রাসায়নিকের গুদামগুলো সরানোর তোড়জোড় থাকলেও এখন তা আর কারও মনে নেই। শুধু যারা স্বজন হারিয়েছেন, তারাই দিনটি মনে রেখেছেন।
নিমতলী যেদিন আগুনে জ্বলছিল, সেই রাতে স্থানীয় বাসিন্দা রুনার বিয়ের পানচিনির অনুষ্ঠান ছিল। ওই মাসেই বিয়ের দিন-তারিখ নির্ধারিত ছিল বড় বোন সাকিনা আক্তার রত্নারও। একই এলাকার আসমা আক্তারেরও বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তিনজনের বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রায় সব আয়োজন শেষ করে এনেছিলেন তাদের স্বজনরা। কিন্তু আগুনে স্বজনের সঙ্গে তাদের সংসার করার সব স্বপ্নটুকুও পুড়তে বসেছিল। ওই রাতে রুনা ও রত্না তাদের মা, ভাই, নিকটাত্মীয়সহ সাতজনকে হারান। রুনার বরপক্ষের পরিবারেরও
সাতজন অঙ্গার হয়ে মারা যান। আসমার মা, খালা, ভাতিজিসহ তিনজনকে কেড়ে নেয় আগুন। এমন ঘটনার পর তাদের বিয়ে যখন ভাঙতে বসে, তখনই তিনকন্যার জন্য মায়ের মমতায় এগিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তিনজনকেই আপন কন্যার মর্যাদায় নিজের সরকারি বাসভবন গণভবনে নিয়ে বিয়ে দেন পারিবারিকভাবে ঠিক করা বরদের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী চাকরি দেন তিন বরকেই।
রুনা ও রত্নার এক স্বজন কালবেলাকে বলেন, এত বছর পরও প্রধানমন্ত্রী তাদের মনে রেখেছেন। ঈদসহ নানা অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে তাদের নিমন্ত্রণ আসে, উপহার আসে। প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর মিরপুরে তিন কন্যাকে পৃথক তিনটি ফ্ল্যাটও উপহার দিয়েছেন।
নিমতলীর ৫৫ নম্বর বাড়িতে সেই আগুনে অঙ্গার হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৬ জন। তাদের মধ্যে বাড়ির মালিক শরীফ উদ্দিন দোলা মা, ছোট তিন ভাই, নানি, মামাসহ ছয়জনকে হারান। তিনি বলেন, অনেকেই শুধু ৩ জুন ভয়াবহ ঘটনাটি মনে করেন। কিন্তু এ ট্র্যাজেডি সবসময় তাকে পোড়ায়। এ ভয়াবহ আগুনের দায় কার, তা জানতে পারেননি এক যুগের বেশি সময় পরও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই আগুনে ১২৪টি প্রাণ গেলেও কোনো মামলা হয়নি। বংশাল থানায় একটি জিডি করেই মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। এতে আগুনের জন্য দায়ী কে, তা-ও শনাক্ত হয়নি।