সরকারবিরোধী আগামীর আন্দোলন সামনে রেখে সংগঠন পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে ঈদুল আজহার আগে জাতীয়তাবাদী যুবদল ও ঢাকা মহানগর বিএনপিসহ একাধিক ইউনিটের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। ঈদের পরপরই সেখানে কমিটি গঠনের সম্ভাবনা থাকলেও ১৫ দিনেও নতুন কমিটি হয়নি। কমিটি গঠনে এই বিলম্বে নেতৃত্ব নিয়ে এক ধরনের জটিলতা দেখা দিয়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে নেতৃত্বকেন্দ্রিক নানা সমীকরণও।
দলের দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা বলছেন, ঈদুল আজহার পরই নতুন কমিটি ঘোষণার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ঈদের পর দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়ায় কমিটিকেন্দ্রিক তৎপরতা ঝিমিয়ে পড়েছে। তাছাড়া তরুণদের দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের চিন্তাভাবনা রয়েছে বিএনপির হাইকমান্ডের। দলের এমন মনোভাব জেনে মহানগরের রাজনীতিতে সক্রিয় সিনিয়র নেতারাও কমিটিতে পদ পেতে শেষ মুহূর্তে তৎপর হয়ে উঠেছেন। এর বাইরে দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতাও নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে জোরালো অবস্থান নেওয়ায় এসব ইউনিটের নেতৃত্ব নিয়ে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। নতুন নেতৃত্ব বাছাইয়ে কার্যত হিমশিম খাচ্ছে দল। বিএনপির হাইকমান্ড এখন পর্যন্ত তরুণ নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে বিএনপির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ঢাকাসহ দেশব্যাপী তিন দিনের সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ৩ জুলাই জেলা পর্যায়ে এই কর্মসূচি শেষে নতুন কমিটি আলোর মুখ দেখতে পারে। জানা গেছে, আজ শনিবার ঢাকায় অনুষ্ঠেয় সমাবেশের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি কর্মসূচিকে নতুন কমিটির নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্র হিসেবেও বিবেচনা করছে বিএনপি। কারণ, ঢাকার এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে সদ্য বিলুপ্ত দলের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং কেন্দ্রীয় যুবদলের নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন কমিটিকেন্দ্রিক আবহ থাকায় বিষয়টি মাথায় রেখে নিজ নিজ কর্মীসমর্থকদের নিয়ে সমাবেশে আলাদাভাবে ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন পদপ্রত্যাশী নেতারা।
সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলন ব্যর্থতার মূল্যায়নসাপেক্ষে ঘুরে দাঁড়াতে ১৩ জুন ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগর বিএনপির সঙ্গে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিলুপ্ত করা হয় ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম শাখা ছাত্রদলের কমিটিও।
নতুন কমিটির শীর্ষ পদে আসতে লবিং-তদবির, দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রেখেছেন পদপ্রত্যাশী নেতারা। জানা গেছে, বিগত আন্দোলন ব্যর্থতায় আগামীতে তরুণ নেতৃত্বে ঢাকার দুই মহানগরকে সাজানোর পরিকল্পনা করছে দলের হাইকমান্ড। সে অনুযায়ী স্থায়ী কমিটিসহ দলের বিভিন্ন ফোরামের নেতাদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। মহানগরের সিনিয়র নেতারাও নেতৃত্বে আসতে ইচ্ছুক। এ জন্য দলের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগও করছেন তারা। দলের একটি প্রভাবশালী অংশও তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কারও কারও মতে, শুধু তরুণদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হলে মহানগরের সঙ্গে সম্পৃক্ত সিনিয়র নেতাদের আর রাজনীতি করার জায়গা থাকে না। দলের একটি অংশ এ বিষয়টি হাইকমান্ডকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, বিকল্প হিসেবে সিনিয়রদের যোগ্যতা অনুযায়ী দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
দলীয় সূত্র জানায়, মহানগর উত্তর বিএনপিতে নেতৃত্বের কিছুটা সংকট রয়েছে। তরুণ নেতৃত্ব আনার ক্ষেত্রে মহানগরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কিংবা অভিজ্ঞতা আছে—এ রকম নেতার সংকট আছে। এ কারণে এখানে দলের হাতে খুব বেশি অপশনও নেই।
জানা যায়, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব ও উত্তর বিএনপির বিদায়ী কমিটির সদস্য সচিব সাবেক ফুটবলার আমিনুল হককে দিয়ে মহানগর উত্তরের নতুন কমিটি গঠনের সম্ভাবনা বেশি। শুরুতে আমিনুলের সভাপতি হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা থাকলেও সম্প্রতি নীরব কারামুক্ত হওয়ায় কমিটি ঘিরে নতুন এই সমীকরণ তৈরি হয়েছে। নীরবের সঙ্গে ইতোমধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান স্কাইপিতে কথা বলেছেন। তাছাড়া যুবদলের সাবেক এই সভাপতিকে ঘিরে দলের প্রভাবশালী একটি মহলও বেশ জোরালোভাবে মাঠে নেমেছেন। এসব কিছু মিলিয়ে উত্তরের শীর্ষপদে নীরবের নেতৃত্বে আসার জোরালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
অবশ্য বিদায়ী কমিটির মূল নেতাদের রেখেই মহানগর উত্তর বিএনপির নতুন কমিটি গঠনের জোরালো দাবিও রয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে দলের হাইকমান্ডের কাছে ইতোমধ্যে এই দাবি জানিয়েছেন বিদায়ী কমিটির কয়েকজন নেতা। তারা আমিনুলকে সভাপতি হিসেবে চান। তাদের দাবি, বাইরে থেকে কাউকে এনে দায়িত্ব দেওয়া হলে মহানগর উত্তর বিএনপি ঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারবে না।
এ ছাড়া উত্তরের নেতৃত্বে যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এস এম জাহাঙ্গীরের নামও শোনা যাচ্ছে। এদের বাইরে সাধারণ সম্পাদক পদে বিদায়ী কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, মোস্তাফিজুর রহমান সেগুন, এ জি এম শামসুল হক, আতাউর রহমান চেয়ারম্যান, মোস্তফা জামান, আক্তার হোসেন এবং উত্তর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম কফিল উদ্দিন আহমেদের নাম আলোচনায় রয়েছে। উত্তরের বিদায়ী কমিটির দপ্তরের দায়িত্ব পালন করা সদস্য এ বি এম এ রাজ্জাকও পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। বিদায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য তাবিথ আউয়ালের নামও আলোচনায় রয়েছে। তারা নেতৃত্বপ্রত্যাশী হলেও শীর্ষপদে নাও থাকতে পারেন।
দক্ষিণ বিএনপিতে নেতৃত্বের কোনো সংকট নেই। শুরু থেকেই বিদায়ী কমিটির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুকে সভাপতি ও যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদ রবিনকে সাধারণ সম্পাদক করে দক্ষিণে নতুন কমিটি গঠনের জোরালো আলোচনা রয়েছে। সম্প্রতি বিদায়ী কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নবী উল্লাহ নবীকে ঘিরে দলের একটি প্রভাবশালী মহলও জোরালো তৎপরতা শুরু করেছে। দলের হাইকমান্ডকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছেন তারা। এতে করে সভাপতি পদে নবী উল্লাহর একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। খোকাপন্থি হিসেবে পরিচিত নবী উল্লাহর মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে প্রভাবও রয়েছে। সেক্ষেত্রে নবী উল্লাহ ও মজনুকে দিয়েও নতুন কমিটি গঠন করা হতে পারে। এদের বাইরে দক্ষিণ বিএনপির সাবেক সহসভাপতি হামিদুর রহমান হামিদ ও সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক হাবিবুর রশিদ হাবিব এবং বিলুপ্ত কমিটির সিনিয়র সদস্য ইশরাক হোসেনের নামও আলোচনায় রয়েছে।
এদিকে যুবদলের নতুন কমিটিতে শীর্ষ পদপ্রত্যাশী হিসেবে বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্না এবং সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম নয়ন সুস্পষ্টভাবে এগিয়ে রয়েছেন। সংগঠনের অধিকাংশ নেতাকর্মীও নতুন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাদের চান। মোনায়েম মুন্নার এরই মধ্যে সারা দেশে সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে মুন্না কারাগারে আটক থাকায় যুবদলের পক্ষে রাজপথে আন্দোলন সংগঠিত করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন নুরুল ইসলাম নয়ন। এ ছাড়া সভাপতি হিসেবে বিদায়ী কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসানের নামও আলোচনায় রয়েছে। শীর্ষ পদের দৌড়ে বিদায়ী কমিটির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন ও সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারও রয়েছেন। যুবদলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানেরও জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, কমিটি গঠন, পুনর্গঠন চলমান প্রক্রিয়া। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর বিএনপি ও কেন্দ্রীয় যুবদলসহ কয়েকটি ইউনিটের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। দলের হাইকমান্ড যখনই উপযুক্ত মনে করবেন, তখনই সেখানে নতুন কমিটি দেবেন।