এবারের উপজেলা নির্বাচনে জনগণ ভোট বর্জন করেছে বলে দাবি বিএনপির। এই ভোট বর্জনে খুশি দলটির হাইকমান্ড। বিএনপি আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছিল এবারের উপজেলা নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নেবে না। এর পরও দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন, সারা দেশে এমন ২২০ জনেরও বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ফলে যেসব নেতা এবারের উপজেলা নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি, তারা দুকূলই হারিয়েছেন। সব হারানো এসব নেতার অনেকেই দলে ফিরতে চান। তবে এ বিষয়ে বিএনপির হাইকমান্ড এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। কোনো নেতা দলে ফিরতে আবেদন করলে সেটি বিচার-বিবেচনা করা হবে বলে জানা গেছে। অবশ্য বিএনপির বহিষ্কৃত নেতাদের মধ্যে ২৮ জন উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন।
গত ৮ মে প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলায় ভোট গ্রহণের মাধ্যমে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন শুরু হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্বাচন বর্জন ও জনগণকে ভোটদানে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে সারা দেশে কয়েক লাখ লিফলেট বিতরণ করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। পথসভা, হাটসভা, কর্মিসভা এবং বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। এতে বিএনপির ডাকে দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষমতাসীন দলের একতরফা উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করেছে বলে বিএনপির নেতারা মনে করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ১/১১ থেকে দেশে গণতন্ত্র নেই। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রে এবার গরু-ছাগলও দেখা যায়নি। মাত্র ৭ শতাংশ ভোটার অংশ নিয়েছিল। জনগণ সব নির্বাচন বর্জন করেছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাই বিশ্বাস করে না যে, ভোট সুষ্ঠু হবে। তাই তারাও ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছে না। সুতরাং আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আহ্বানে দেশের ৯৩ শতাংশ মানুষ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। যেখানে জাতীয় নির্বাচন জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে, সেখানে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কথা বলার কিছু নেই।
গত ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপিসহ প্রায় ৬৩টি রাজনৈতিক দল। এরই ধারাবাহিকতায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনও বয়কটের ঘোষণা দেয় বিএনপি। ভোটের মাঠে থাকলেও শেষ পর্যন্ত পিছু হটেছে জামায়াতে ইসলামীও। গত ১৫ এপ্রিল বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় সিদ্ধান্ত হয়, যারা নির্বাচনে যাবেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবুও বিএনপির অনেক নেতা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হন। প্রথম ধাপে ৮০ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৬৯ জন, তৃতীয় ধাপে ৫৫ জন এবং চতুর্থ ধাপে মোট ১৩ জন নেতা প্রার্থী হন। বিএনপির সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জেলার নেতারা প্রার্থীদের নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেও সফল হননি। হাতেগোনা কয়েকজন প্রার্থী দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেও বেশিরভাগই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেন। যে কারণে এসব নেতাকে প্রথমে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু চিঠির জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেসব নেতাকর্মী কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও দেখা গেছে। বিভিন্ন উপজেলায় স্থানীয় বিএনপির সিনিয়র নেতারা প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি সংশ্লিষ্ট জেলা বিএনপির পক্ষে ব্যবস্থা নিতে লিখিতভাবে আবেদন করলেও তা আমলে নেয়নি কেন্দ্র। এর আগে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ায় দলের প্রায় তিনশর বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।
বিএনপির বহিষ্কৃত নেতাদের মধ্যে অনেকেই উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথম ধাপে ১০ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৬ জন, তৃতীয় ধাপে ৯ জন এবং চতুর্থ ধাপে নির্বাচিত হয়েছেন ৩ জন।
শেরপুরের নকলা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছেন জেলা বিএনপির সদস্য মো. মুকশেদুল হক শিপলু। তিনি গতকাল কালবেলাকে বলেন, ১১ বছর কারাগারে ছিলাম। অনেক অত্যাচার-নির্যাতন সয়েছি। এলাকার মানুষের ভালোবাসা ও সমর্থনে নির্বাচনে ছিলাম। দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও স্থানীয় নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে ছিলেন এবং আছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি, দালালি করিনি। আমাকে কারসাজি করে পরাজিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের দলের কিছু নেতা বাইরে থেকে এসে ষড়যন্ত্র করে লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে নির্বাচনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান। অথচ আমার পাশেই ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলা। সেখানে তো কোনো লিফলেট বিতরণ কিংবা সভা করা হয়নি। তাহলে কি দ্বিচারিতা হলো না? আজকে দল আমাকে সমর্থন দিলে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতাম। আমি চেয়ারম্যান হলে দলকে গোছাতে পারতাম, নেতাকর্মীরা বিপদে পড়লে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারতাম। দল মনে করলে আমার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করবে বলেও জানান তিনি।
গাজীপুর সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপি নেতা ইজাদুর রহমান মিলন। তিনি গতকাল কালবেলাকে বলেন, উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে দল ভুল করেছে। যেহেতু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নেই, আমরা জয়ী হলে তো দলকে ব্যাকআপ দিতে পারতাম। এতদিন ধরে শুধু কমিটি গঠন করা হচ্ছে, তাতে দলের লাভটা কী। আমাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারিনি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখনো নির্বাসনে। কিছুই তো করতে পারলাম না। এভাবে রাজনীতি করলে তো চলে না। কোরবানির ঈদের পর শপথ নিয়ে দলে ফেরার বিষয়ে চিন্তা করবেন বলেও জানান তিনি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, যে দেশে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই, সেই দেশে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদে ভোটারবিহীন নির্বাচনে কেউ চেয়ারম্যান ঘোষিত হলে হাতিশালায় হাতি ও ঘোড়াশালায় ঘোড়ার কোনো অভাব হয় না। আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের স্বজন ছাড়া অন্য কেউ নির্বাচিত হতে পারে না। ভোটারদের ভোটের প্রয়োজন হয় না। ফল নির্ধারিত থাকে, সেটিই ঘোষিত হয়। আওয়ামী প্রতারণার ফাঁদে পা না দিয়ে দেশের ভোটাররা সর্বান্তকরণে উপজেলা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে, এটা তো নিঃসন্দেহে স্বস্তির খবর। কারণ জনগণ দুর্নীতিবাজ এই ডামি সরকারকে বর্জন করেছে। বহিষ্কৃতরা দলে ফেরার আবেদন করলে সেটি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজে দেখবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।