আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক মিলে এই রাজস্ব আহরণ করবে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সরকার করের বেড়াজালে আটকে দিয়েছে সাধারণ মানুষকে। আর সেবার ক্ষেত্রেও নতুন করে বাড়ানো হয়েছে ভ্যাটের হার। চলাফেরা থেকে শুরু করে বিয়ের স্থান ভাড়া, এমনকি বাসা-বাড়ির বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী লাইট কিনতেও লাগবে বাড়তি অর্থ। আয়কর খাতে করহার কমানোর ঘোষণা দিলেও শর্তের কারণে আটকে যাবে অনেকে করপোরেট প্রতিষ্ঠান। এনবিআরের রাজস্ব বাড়ানোর পরিকল্পনা বিশ্লেষণে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব বাড়ানোর কর বিন্যাসের কারণে কোম্পানি থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকেও ভুগতে হবে। আর ভ্যাটের হার বাড়ার কারণে কোমল পানীয় থেকে শুরু করে জুস খেতে গুনতে হবে বাড়তি অর্থ। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া শর্ত ভ্যাটের অভিন্ন হার বাস্তবায়নে নাকাল হবে ভোক্তা। প্রাথমিকভাবে ১১ ধরনের সেবার বিপরীতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। এতে ভোক্তার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। শুল্কহারেও উল্লেখযোগ্য হারে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে ঘরের বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী লাইটেও গুনতে হবে বাড়তি অর্থ।
আয়কর বিভাগের প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করের আওতা বাড়াতে উৎসে করে বেশকিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে হোটেল-মোটেল থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নবায়নে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র পেশ করতে হবে। আর কমিউনিটি সেন্টার বা কমিউনিটি হল ভাড়া নিতে গেলেও দেখাতে হবে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র। অর্থাৎ কারও আয় না থাকলেও বিয়ে করার স্থান ভাড়া করতে রিটার্নের প্রমাণ দিতে হবে। কোনো সেলুলার ফোন উৎপাদনকারীর পরিশোধিত আয় বণ্টন, লাইসেন্স ফি বা অন্য কোনো ফি বা চার্জ থেকে আসা আয়ের ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হতে পারে। ইটভাটা মালিকদের লাইসেন্স নবায়নেও দিতে হবে বাড়তি কর। করপোরেট করহার আড়াই শতাংশ কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু এর সঙ্গে শর্তজুড়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার স্থরভেদে আড়াই শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। অবৈধ আয়ে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিপরীতে সৎকরদাতাদের ব্যক্তি খাতের সর্বোচ্চ করহার ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
শুল্ক খাতের প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আইএমএফের চাপে এ খাতে অব্যাহতি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে সংকুচিত করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। ফ্রিজের কম্প্রেসার আমদানির শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ঘরের প্রয়োজনীয় এই পণ্য কিনতে হবে বাড়তি দামে। শুল্ক আরোপের কারণে এয়ারকন্ডিশনার ব্যবহারেও খরচ বাড়ছে। রেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশনের কাঁচামালের রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করে নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। এয়ারকন্ডিশনের স্টিল শিটের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত যেসব পণ্যের শুল্ক ১০ শতাংশ রয়েছে, তা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এলইডি লাইটে নতুন করে ১০ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে জেনারেটর তৈরির উপকরণ শূন্য শতাংশ থেকে ১ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ইলেকট্রিক খাতের সুইচ, সকেট ও হোল্ডারের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ কমিয়ে আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। আয়রন তৈরির কাঁচামাল আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এ ছাড়া নতুন করে কাজুবাদামের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ এবং রেগুলেটরি ডিউটি ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
ইলেকট্রিক মিটারের আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রি-পেইড কিলোওয়াট মিটারের যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে বাসাবাড়িতে মিটার বসানোর খরচ বাড়বে। নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সিসি ক্যামেরা এবং এটিএমের উপকরণের শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের খরচ আরও বাড়বে। ওয়াটার পিউরিফাইর আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বিশুদ্ধ পানি পানের খরচও বেড়ে গেল। এ ছাড়া ব্যাগেজ রুলে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাব এনেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে প্রবাসীদের স্বর্ণ ও মোবাইল ফোন নিয়ে আসার খরচও বেড়ে গেল।
ভ্যাটের প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভ্যাট আদায়ের বাড়তি চাপে মেট্রোরেলের ভ্যাট অব্যাহতি তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে মেট্রোরেলের যাত্রীদের ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। অর্থাৎ মেট্রোরেল চড়তে গেলে বাড়তি টাকা গুনতে হবে। এই গরমে কোমল পানীয় পান করতে গেলেও গুনতে হবে বাড়তি অর্থ। কারণ কার্বোনেটেড বেভারেজের সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে ৫ শতাংশ। জুস খেতে গেলেও গুনতে হবে আগের তুলনায় বাড়তি অর্থ। কারণ চিনিযুক্ত জুসের ভ্যাটের হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। মোবাইল ফোনে কথা বলতে গেলেও গুনতে হবে বাড়তি অর্থ। কারণ অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটে টকটাইমের সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। প্রতিনিয়ত প্রয়োজন এমন সব বিষয়ে ভ্যাটের হার বাড়ানোর কারণে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়বে।