৬৫ বছরের নুর নবী। বছরের এই মৌসুমে যখন মৎস্য আহরণ বন্ধ থাকে, তখন জাল বাঁধা, ট্রলার মেরামতে দিন কাটে তার। এবারও তেমন অলস সময় কাটছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর পাড়ে। সঙ্গে ভেসে আসছে অতল সাগরে প্রিয়জন হারানোর স্মৃতি। এই সাগরেই মাছ আহরণে গিয়ে নূর একে একে হারিয়েছেন বাবা-ভাইকে। সাগরের বুকে বিলীন হয়েছে তাদের ভিটেবাড়িও। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে হারান ১১ জন সহকর্মী। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে ফেরেন। সাগরে এতকিছু হারিয়েও মাছ আর জালের নেশা তাকে ছাড়ে না; কিন্তু ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকায় এখন অলস সময় কাটছে তার।
গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় সব ধরনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে সাগরে থেকে তীরে ফিরে আসে মাছ ধরার ট্রলারগুলো। জেলেদের অনেকেই যোগ দেন অন্য কাজে। বেশির ভাগ জেলে জীবিকার খোঁজে অন্য কাজে চলে গেছেন। জেলেরা জানিয়েছেন, আগামী দুই মাস সাগরে না ফেরা পর্যন্ত নৌকা ও জাল মেরামতের পাশাপাশি খোশগল্পেই সময় কাটবে তাদের। তবে অনেকের মাঝে দেখা গেছে রুটি-রুজির অনিশ্চয়তাও।
মাছ ধরার ট্রলার মাসুদা শাহীনের হেড মাঝি নুর নবী কালবেলাকে বলেন, ‘মাছ ধরা বন্ধ ঘোষণা করায় দুই দিন আগে এখানে (কর্ণফুলীর পাড়ে) এসেছি। এখন জাল মেরামত করছি। জালটি প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা। পাশাপাশি ট্রলার মেরামতের কাজ চলছে।
অনেকেই অন্য কাজে গিয়েছেন। তবে আমার অন্য কাজ ভালো লাগে না। সাগরে আমার বাবা-ভাই মারা গেছেন। তবুও এ কাজটিই আমার ভালো লাগে; কিন্তু আমি চাই না আমার সন্তান কেউ এ পেশায় আসুক।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৬৫ দিন মৎস্য আহরণ বন্ধ ঘোষণায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, সন্দ্বীপ, বাঁশখালী ও আনোয়ারা এলাকায়ও জেলেদের একই চিত্র। মৎস্য আহরণে বিরত থাকা মৎস্যজীবীদের আপদকালীন বিকল্প আয় বা খাদ্য সহায়তা হিসেবে দুই কিস্তিতে ৬৫ দিনের জন্য ৮৬ কেজি হারে জেলে পরিবারকে ভিজিএফ বরাদ্দ দেওয়ার কথা রয়েছে। জীবিকার বরাদ্দ পেলেও জেলেদের সংগ্রামের জীবনটা চলছেই। সাগরে ফিশিং ট্রলারে গিয়ে কেউ হারিয়েছে বাবাকে, কেউ বা হারিয়েছেন সন্তান। অনেকেই ঝড়ের কবল থেকে জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারলেও দুবির্ষহ স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায় তাদের। তাদেরই একজন নুর নবী।
তিনি কালবেলাকে জানিয়েছেন, বংশগত পরম্পপরায় তিনি এ পেশায় যুক্ত। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের কবলে হারিয়ে যায় তার ১১ সহকর্মী। সেই ট্রলারডুবির পর বয়ায় ভেসে তিনি চলে যান পাশের দেশ ভারতে। সেখান থেকে ফেরেন ২১ মাস পর। দেশে ফিরে চলে যান কাতার; কিন্তু সেখানে শ্রমিকের কাজ পছন্দ হয়নি তার। কিছু দিন আবারও কাতার সাগরে জেলে পেশায় যুক্ত হন। ২০১৪ সালে আবারও দেশে ফিরে মাছ ধরার ট্রলারে যোগ দেন। এরই মধ্যে ২০২০ সালে জলদস্যুদের হাতে প্রাণ হারান তার ভাই মো. আলমগীর। আর তাদের বাবা মো. ইউনুছ ৩৫ বছর আগে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়েন। চার দিন পর পানিতে ভেসে ওঠে বাবার মরদেহ।
আল ফাহাদ ফিশিং ট্রলারের মালিক জামাল আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘সাগরের মাছ ধরার কাজটি অনেক কঠিন। সবসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা সাগরে যায়। ফিরে আসার নিশ্চয়তা থাকে না। ঘূর্ণিঝড়, বিপদ-আপদ লেগেই থাকে। ঝড়ের সময় অনেকেই হারিয়ে যায়।’