কবির হোসেন
প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৪, ০২:১৪ এএম
আপডেট : ১৫ মে ২০২৪, ০৭:২৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কনডেমড সেলে বন্দি ২ হাজার ৫৫৬

অবিচারের শিকার অনেকেই
কনডেমড সেলে বন্দি ২ হাজার ৫৫৬

২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় জনপ্রিয় নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আলোচিত এ হত্যা মামলার বিচার শেষ হয় ২০০৫ সালে। বিচারিক আদালতের রায়ে বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এর প্রায় ১১ বছর পর ২০১৬ সালে হাইকোর্ট এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায় দেন। রায়ে ৬ জনের ফাঁসি বহাল রাখা হয়। বাকিদের কেউ কেউ খালাস পান, দু-একজন কারাগারে থাকাবস্থায় মারা যান, কারও কারও সাজা কমে যায়। পরবর্তী ধাপে মামলাটি এখনো আপিল বিভাগে বিচারাধীন। ফলে বিচারিক আদালতে রায় ঘোষণার পর ১৯ বছর পার হতে চললেও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তাদের আপিল শুনানি শেষ হলে রিভিউ আবেদন হবে। এরপর রিভিউ শুনানির মধ্য দিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে। আসামিদের কয়েকজন কারাগারের কনডেমড (ডেথ) সেলে বন্দি রয়েছেন।

এভাবে বিভিন্ন মামলায় সারা দেশের কারাগারগুলোতে বর্তমানে ২ হাজার ৫৫৬ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছেন। এসব আসামিকে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নির্জন কনডেমড সেলে বন্দি রাখা হয়েছে। তাদের সবারই আপিল ও ডেথ রেফারেন্স দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। কারও কারও আপিল বিচারাধীন হাইকোর্টে। আর কারও আপিল বিচারাধীন আপিল বিভাগে।

তাদের বিচার কবে শেষ হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চূড়ান্ত বিচারের আগে ডেথ সেলে রাখাটা অমানবিক। এতে অনেকেই অবিচারের শিকার হচ্ছেন।

জানা গেছে, বর্তমানে বিচারিক আদালত থেকে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে পাঠানো ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি চলছে। এসব মামলার আসামি ৬ থেকে ৭ বছর ধরে কনডেমড সেলে বন্দি রয়েছেন। এ ছাড়াও রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় করা হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্সের বিচারসহ ব্যতিক্রম দু-একটি মামলার বিচার ঝুলে আছে আরও দীর্ঘ সময় ধরে। বর্তমানে উচ্চ আদালতে এ ধরনের প্রায় এক হাজার ডেথ রেফারেন্স মামলা বিচারাধীন। কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, হাইকোর্টে বিচারাধীন এসব মামলায় আসামি ১২ শতাধিক। এ ছাড়া ১৩ শতাধিক আসামির আপিল বিচারাধীন আপিল বিভাগে। আপিল বিভাগে বিচারাধীন এসব আসামির বেশিরভাগই এক যুগের বেশি সময় ডেথ সেলে বন্দি রয়েছেন। তার পরও কবে তাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে তার নিশ্চয়তা নেই।

এর আগে ২০২২ সালে কালবেলার এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই বছরের সেপ্টেম্বরে চলা অবকাশে দেড় মাসে ২৯টি ডেথ রেফারেন্স মামলার রায় হয়। এসব মামলায় ৭৭ আসামির মধ্যে ৫০ সজনেরই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। শতকরা হিসাবে এটি দাঁড়ায় ৬৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর আগে ওই বছরের ২০ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত চলা অবকাশে হাইকোর্টের ১১টি বিশেষ বেঞ্চে ৩০টি ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হয়। এসব মামলায় ৬৭ আসামির মধ্যে ৫৮ জনের মৃত্যুদণ্ড টেকেনি হাইকোর্টে। শতকরা হিসাবে এটি দাঁড়ায় ৮৬ দশমিক ৫৬ ভাগ। হাইকোর্টে যাদের ফাঁসির আদেশ বহাল থাকে তাদের আবার বড় একটি অংশের সাজা কমে যায় অথবা খালাস পান আপিল বিভাগের রায়ে। আইনজীবীদের মতে, বিচারিক আদালতে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্তদের মধ্যে চূড়ান্ত ধাপে ফাঁসির আদেশ বহাল থাকে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ শতাংশ আসামির। বাকি আসামিরা হয় খালাস পান, তা না হলে সাজা কমে যায়। কিন্তু চূড়ান্ত রায়ের আগেই কনডেমড সেলে কাটাতে হয় বছরের পর বছর। বিষয়টি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারের লঙ্ঘন বলছেন আইনজীবীরা।

জানা যায়, বিচারিক আদালতে কারও মৃত্যুদণ্ড হলে কারাবিধি (বাংলাদেশ জেল কোড) ৯৮০ অনুযায়ী তাকে কারাগারের বিশেষ সেলে রাখা হয়, যা কনডেমড সেল নামে পরিচিত। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী, হাইকোর্টের অনুমোদন ছাড়া ফাঁসির সাজা কার্যকর করা যায় না। এ জন্য বিচারিক আদালতে কারও ফাঁসির আদেশ হলেই দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির রায়সহ যাবতীয় নথি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠাতে হয়। এটিকে বলে ডেথ রেফারেন্স। পেপারবুক তৈরি সাপেক্ষে মামলাগুলো পর্যায়ক্রমে শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ওঠে। অন্যদিকে বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল ও জেল আপিলের সুযোগ পান। হাইকোর্টে সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকলে আসামিরা আপিল বিভাগে আপিল ও জেল আপিল করতে পারেন। আপিল বিভাগের রায়েও মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে আপিল বিভাগের রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) চেয়ে আবেদন করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারেন। ক্ষমার এই আবেদন রাষ্ট্রপতি যদি না মঞ্জুর করেন অথবা দণ্ডিত আসামি যদি আবেদন না করেন তাহলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারে সরকার। তবে আগেই অনেক আসামি খালাস পেয়ে যান। উচ্চ আদালতের রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও এর আগেই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের অনেকেরই কনডেমড সেলে বন্দি থাকতে হচ্ছে।

এ ব্যাপারে ড. শাহদীন মালিক কালবেলাকে বলেন, একজন আসামির চূড়ান্ত বিচার হতে এক থেকে দেড় যুগ লেগে যাচ্ছে। এতদিন কনডেমড সেলে রাখার অর্থ আসামির প্রতি নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করা যা সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চূড়ান্ত বিচারের আগেই কাউকে কনডেমড সেলে না নেওয়াটা হবে মানবিক ও বিবেচনাপ্রসূত। আশা করব হাইকোর্ট এ বিষয়ে যে রায় দিয়েছেন, রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে আপিল করা থেকে বিরত থাকবে। তা না হলে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অনেকেই অবিচারের শিকার হয়ে যাচ্ছেন।

হাইকোর্টের রায়: এর আগে সোমবার হাইকোর্ট এক রায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে কারাগারের কনডেমড সেলে বন্দি রাখা অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেছেন। জনস্বার্থে করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি করে এমন রায় দেন বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের বেঞ্চ। রায়ে আদালত বলেছেন, কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড আপিল বিভাগ এবং রিভিউয়ের পরও বহাল থাকলে এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমার আবেদনও নাকচ হয়ে গেলে তখনই তার ‘মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত’ হয়েছে বলে ধরতে হবে। একই সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ‘চূড়ান্ত হওয়ার আগেই’ যাদের কনডেমড সেলে রাখা হয়েছে, তাদের পর্যায়ক্রমে সাধারণ সেলে স্থানান্তর করতে জেল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর এ কাজের জন্য দুই বছর সময় বেঁধে দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে, কোনো দণ্ডিত আসামি যদি তেমন কোনো সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হন যে, তাকে অন্যদের সঙ্গে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ, তখন তাকে কনডেমড সেলে রাখা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন আদালত। তবে এ ক্ষেত্রেও আলাদাভাবে দণ্ডিতের বক্তব্য শোনার শর্ত দেওয়া হয়েছে। এ রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত চেয়ে গতকাল রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে একটি আবেদন করেছে। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানিয়েছেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে আমরা আপিল করব। এখন রায় স্থগিত চেয়ে একটি আবেদন করা হয়েছে। এটি বুধবার আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে শুনানি হবে।

এদিকে হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংগঠনটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশের পরপরই সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কনডেমড সেলে বন্দি রাখা হচ্ছে, যা অত্যন্ত অমানবিক। মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিদের কনডেমড সেলে না রাখার রায়ের মাধ্যমে আসামিদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সুপার স্পেশালাইজডের বিদ্যমান আইনে নতুন সংযোজন প্রয়োজন : বিএসএমএমইউ উপাচার্য

ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে ঢাবিতে কোটা বিরোধী বিক্ষোভ শুরু

এশিয়া কাপের আম্পায়ারিং প্যানেলে জেসি

যে কারণে ইয়ামালকে পুরো ম্যাচ খেলাচ্ছে না স্পেন?

দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকে আরেক ট্রাকের ধাক্কা, নিহত ২

চমেক হাসপাতালে বার্ন ইউনিটের নির্মাণকাজ সেপ্টেম্বরে শুরু : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

পুলিশি বাধায় তাঁতীবাজার মোড়ে অবস্থান জবি শিক্ষার্থীদের

আকর্ষণীয় বেতনে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট নেবে সিপিডি

যমুনায় পানি কমায় ব্রহ্মপুত্রে ভাঙন

আ.লীগ সরকারের কাছে আলেম-ওলামারাও রেহাই পায়নি : টুকু

১০

কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে বেরোবি শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ

১১

ইউরো ২০২৪ / স্টুটগার্টে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, পিতা-পুত্রের স্মরণীয় উদযাপন

১২

বেসরকারি সংস্থায় চাকরির সুযোগ, বেতন ৬০ হাজার

১৩

তীব্র বৃষ্টি উপেক্ষা করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ইবি শিক্ষার্থীরা

১৪

দেশবাসীর কাছে দোয়া চাইলেন ডিপজল

১৫

বিপৎসীমার ওপরে টাঙ্গাইলের সব নদীর পানি

১৬

পিজিআরকে অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের নির্দেশ রাষ্ট্রপতির

১৭

পেট্রোম্যাক্স এলপিজিতে নিয়োগ, পদসংখ্যা অনির্ধারিত

১৮

পঞ্চম দিনে কোটাবিরোধী আন্দোলনে জবি শিক্ষার্থীরা

১৯

বৃক্ষমেলার আড়ালে বাণিজ্য মেলা!

২০
X