দলীয়ভাবে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার পর জনগণকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে এবার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করা বিএনপি। ভোটারদের শান্তিপূর্ণভাবে ভোট বর্জন করার আহ্বান জানিয়ে তৃণমূলে চালানো হচ্ছে ক্যাম্পেইন। এর অংশ হিসেবে সাংগঠনিক যৌথসভার পর বিতরণ করা হচ্ছে লিফলেট। গত ২৫ এপ্রিল নরসিংদী থেকে লিফলেট বিতরণের এই কার্যক্রম শুরু করেছে দলটি। উপজেলা নির্বাচনের শেষ ধাপ পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে। দলটির দাবি, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন করেছে। উপজেলা নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালবেলাকে বলেন, বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বিগত ৭ জানুয়ারির একতরফা, ডামি নির্বাচনের ভোট বর্জন করেছে। আমরা জাতীয় নির্বাচনের মতো উপজেলায়ও জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট বর্জনের আহ্বান জানাচ্ছি, তাদের মাঝে লিফলেট বিতরণ করছি।
তিনি বলেন, ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, আমরা না বললেও জনগণ যে ভোট দিতে যাবে না, সেটা বোঝা যায়। কারণ ভোটের যে আনন্দ এবং ভোট দিতে পারার যে নিশ্চয়তা, জনগণ যতদিন সেই নিশ্চয়তা পাবে না, ততদিন পর্যন্ত তারা ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হবে না।
বিএনপি মনে করে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ নেই। যেসব কারণে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বিগত জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেসব কারণ এখনো বহাল আছে। এ অবস্থায় সংসদ নির্বাচন বর্জনের চার মাসের মাথায় উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন হাস্যকর হয়ে যাবে। তা ছাড়া জামায়াতে ইসলামী ও চরমোনাইর পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নির্বাচন না করায় এ নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই থাকছে না। তাই উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে শুরু থেকেই কঠোর অবস্থান নেয় বিএনপির হাইকমান্ড। তবে কঠোর হওয়ার আগে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে অংশগ্রহণকারী দলের নেতাদের ফেরাতে নানামুখী প্রচেষ্টা চালায় বিএনপি। এ উদ্যোগে বেশ কয়েকজন নেতা নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু বাকিরা নির্বাচনে থাকায় সংগঠনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বহিষ্কারের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেয় দল। এর অংশ হিসেবে গত শুক্রবার ৭৩ জনসহ দুদিনে ৭৬ জনকে বহিষ্কার করে বিএনপি। বিএনপির প্রত্যাশা, নির্বাচন নিয়ে কেন্দ্রের কঠোর অবস্থান এবং তৃণমূলে ভোট বর্জন ক্যাম্পেইনের ফলে উপজেলার পরবর্তী ধাপগুলোতে নির্বাচন করতে আগ্রহী দলের নেতাদেরও বিরত রাখা যাবে।
নির্বাচন কমিশনের তপশিল অনুযায়ী, এবার কম-বেশি ৪৮০ উপজেলা পরিষদে চার ধাপে ভোট হবে। প্রথম ধাপে ভোট হবে আগামী ৮ মে। এরপর ২১ মে দ্বিতীয় ধাপে, ২৯ মে তৃতীয় এবং ৫ জুন চতুর্থ ও শেষ ধাপের নির্বাচন হবে।
জানা গেছে, নির্বাচনী এলাকায় বিএনপি ভোটারদের মধ্যে ‘আওয়ামী সরকারের আসন্ন প্রতারণামূলক ডামি উপজেলা ও সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন করুন’ শিরোনামে লিফলেট বিতরণ করছে। লিফলেটে বিএনপির উপজেলা নির্বাচন বর্জনের কারণগুলো তুলে ধরে জনগণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি ও লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপির ২৫ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার এবং সাজা প্রদানের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। সেইসঙ্গে জানানো হয়েছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির একদফা দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথাও।
জনগণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার নরসিংদী সদর উপজেলা থেকে লিফলেট বিতরণের কার্যক্রম শুরু করেছে বিএনপি। ওইদিন জেলা বিএনপি কার্যালয়ে জেলার কর্মিসভা শেষে জনগণের মধ্যে লিফলেট বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ। তিনি কালবেলাকে বলেন, আমরা জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে উপজেলা নির্বাচনের ভোট বর্জনের আহ্বান জানাচ্ছি। এ লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমাদের লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। যেখানে যেখানে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে আমাদের এই ক্যাম্পেইন চলছে। নির্বাচনের শেষ ধাপ পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলবে।
উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপে কুমিল্লার মেঘনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোটারদের ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে সেখানে কর্মিসভা, যৌথসভা শেষে জনগণের মধ্যে লিফলেট বিতরণ করছেন দলের কুমিল্লা (সাংগঠনিক) বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া। তিনি কালবেলাকে বলেন, ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে জনগণের মধ্যে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচিতে আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। আমরা মনে করছি, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ উপজেলা নির্বাচনের ভোট বর্জন করবে।
এদিকে মানবিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বিএনপি। তাদের মধ্যে বিতরণ করছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন। দল ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে রাজধানী ঢাকায় পরিচালিত হচ্ছে এ কার্যক্রম। বিএনপি নেতারা জানান, প্রচণ্ড এই তাপপ্রবাহে দলের নেতারা
স্থান-কাল-পাত্রভেদে যার যার সাধ্য অনুযায়ী মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
তবে এই কর্মসূচিতে বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ ঘুরেফিরে হাতেগোনা কয়েকজন নেতাকে দেখা গেছে। নামেননি দলটির সিনিয়র কোনো নেতা। কেন তারা নামেননি, এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে নানা আলোচনা হচ্ছে। অনেকে বলছেন, পানীয় বিতরণের কর্মসূচিই শুধু নয়, বিএনপির অন্য অনুষ্ঠানগুলোতেও ঘুরেফিরে সেই একই নেতাদের দেখা যায়। তাদের প্রশ্ন, বিএনপি তো
১০, ১৫ কিংবা ২০ জনের দল নয়। কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতেই পাঁচ শতাধিক নেতা রয়েছেন। তাহলে বাকি নেতারা কর্মসূচিতে কেন নামছেন না। প্রশ্ন উঠেছে, দলের হাইকমান্ড সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ কাউকে কি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং দলে অবস্থান অনুযায়ী অন্যদের কি ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না? সেই ক্ষোভ, অভিমান থেকেই কি অন্য নেতারা নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন?