শরীয়তপুরে মনিরুজ্জামান তালুকদার নামে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তালিকা থেকে তার নাম বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা দাবি করেন, একটি মহল তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
মনিরুজ্জামান শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার পুটিয়া গ্রামের হাবিবুর রহমান তালুকদারের ছেলে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম তালুকদার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় বিষয়টি আমলে নেয় মন্ত্রণালয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মনিরুজ্জামান সেনাবাহিনীর জি এল মেজর পদে থাকা অবস্থায় চাকরি থেকে অবসর নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছাত্র ছিলেন। তার দাবি, যুদ্ধের সময় তিনি শরীয়তপুরের আক্কাছ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছেন।
আক্কাছ বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য জানান, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ইপিআর, সেনা ও নৌবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিয়ে আক্কাছ বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনীতে কোনো বেসামরিক লোক ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় মনিরুজ্জামান
কোনো বাহিনীতে ছিলেন না। ছাত্রাবস্থায় থেকে আক্কাছ বাহিনীতে যুদ্ধ করার কোনো সুযোগ ছিল না। ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সভাপতিত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান কমিটির মিটিংয়েও মনিরুজ্জামানের উপস্থিতিতে বেশ কয়েকবারই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া তৎকালীন থানা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আকবর মাস্টারের নেতৃত্বে এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা একজোট হয়ে বিরোধিতা করায় ভাতার তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে আক্কাছ বাহিনীর ভেদরগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা মো. হোসেন মোড়ল কালবেলাকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সঙ্গে একজনও বেসামরিক লোক ছিল না। কেউ যদি দাবি করে সে আক্কাছ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছে, তবে সে মিথ্যা বলছে।
এ বিষয়ে ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছয়গাঁও ইউনিয়নের ছয়গাঁও গ্রামের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া জানান, মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি আক্কাছ বাহিনীতে ছিলাম। এই বাহিনীতে কোনো বেসামরিক লোক ছিল না।
আক্কাছ বাহিনীর আরেক সদস্য নড়িয়া উপজেলার শালদ গ্রামের মো. হাফিজুর রহমান রাঢ়ী বলেন, আমি ও আমার ভাই শহিদ আব্দুল মান্নান রাঢ়ী এই বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছি। যুদ্ধে আমার ভাই শহীদ হয়েছে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই বাহিনীতে কোনো বেসামরিক লোক ছিল না।
ভেদরগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ ভাসানী কালবেলাকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি গেরিলা বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছি। সে সময় আক্কাছ বাহিনীকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আক্কাছ বাহিনীতে শুধু সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই ছিল। এখন কেউ যদি এসে বলে আমি আক্কাছ বাহিনীতে ছিলাম, তবে তা শতভাগ ভুয়া। জয়নাল সুবেদার মারা যাওয়ার পর তার স্বাক্ষরিত একটি কাগজ নিয়ে এসে মনিরুজ্জামান দাবি করেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা। আমার মতে, ওই কাগজটিও ভুয়া। কারণ তিনি কখনো মূল কাগজ দেখাতে পারেননি। বরাবরই কপি দেখিয়েছেন। সার্বিক পর্যালোচনা করে বুঝতে পারছি যে, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার হীন উদ্দেশ্যে জাল কাগজ তৈরি করে তা ব্যবহার করেছেন তিনি।
২০০৫ সালের গেজেটে মনিরুজ্জামানের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। এ ঘটনায় হতবাক হন ভেদরগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের সমালোচনার মুখে তৎকালীন ইউএনও নারায়ণপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মনিরুজ্জামানের ছোট ভাই মো. নাজিম উদ্দীন তালুকদারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চান। তখন তিনি জানান, তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা নন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভাই ছাত্র ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কয়েক বছর পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নায়েব সুবেদার পদে চাকরিতে যোগদান করেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মেজর মনিরুজ্জামান তালুকদার কালবেলাকে বলেন, আমি আক্কাছ বাহিনীতে যুদ্ধ করেছি। কিন্তু একটি মহল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা রটাচ্ছে।
ভেদরগঞ্জের ইউএনও রাজিবুল ইসলাম বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম তালুকদারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে গত বছরের ১৯ অক্টোবর একটি চিঠি পাই। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত মেজর মনিরুজ্জামান তালুকদারের গেজেট বাতিলের জন্য যে চিঠি এসেছে, তাতে ২১ জুন ২০১৭ সালের জারিকৃত প্রজ্ঞাপন সঠিকভাবে মানা হয়নি। তাই এ নিয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছি। কারণ, প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় কারও অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কোনো প্রশ্ন বা বিতর্ক সৃষ্টি হলে তা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট বাহিনীর কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে নিষ্পত্তি করতে হবে।