অস্থির হয়ে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয়

অস্থির হয়ে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি : সংগৃহীত

দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কখনো বখাটে, কখনো পরিবহন শ্রমিক আবার কখনো স্থানীয় এলাকাবাসীর হাতে মার খাচ্ছেন। আবার কোথাও ছাত্র সংগঠনের দুটি গ্রুপের মারামারিতে অস্থির বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। কোথাও আবার চলছে শিক্ষকদের গ্রুপিং। এসব বিষয় বিরূপ প্রভাব ফেলছে শিক্ষার্থীদের মনে। বিশিষ্টজন বলছেন, শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের অসহিষ্ণু আচরণ, নিরাপত্তা দুর্বলতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সবসময় সক্রিয় না থাকার ফলে এসব ঘটনা ঘটছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পূর্ণাঙ্গ আবাসন নিশ্চিত না হওয়ায় এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেসে বা হোস্টেলে থাকেন। তারা বাইরে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কথা বলার পরিবেশ পান না। এ ছাড়া উন্মুক্ত হওয়ায় অনেক ক্যাম্পাসেই বহিরাগতরা অবাধে বিচরণ করে। অনেক সময় বখাটে কর্তৃক নারী শিক্ষার্থী হয়রানির খবর পাওয়া যায়। ক্যাম্পাসের ভেতরে বহিরাগতরা কিছু করার সাহস না পেলেও ক্যাম্পাসের বাইরে তুচ্ছ ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। তাই শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় ক্যাম্পাস বহিরাগত ও বখাটে মুক্ত করা, শতভাগ আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা, শিক্ষার্থী-স্থানীয় সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইত্যাদির ওপর জোর দিয়েছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি সংঘটিত ঘটনাগুলোর মধ্যে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনা অন্যতম। গত সোমবার বহিরাগত তরুণের গোপনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভিডিও ধারণ নিয়ে তর্কাতর্কি এবং এর জেরে ক্যাম্পাস-সংলগ্ন শেখপাড়া বাজারে দুই শিক্ষার্থীকে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে ফেলে এলোপাতাড়ি মারধর করা হয়।

বখাটেদের হামলায় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হাসান জিসাদ ও ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী সুপ্ত হাসান আহত হন। তাদের কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ছাড়া সংঘর্ষের পেছনে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের মাদক সেবনও অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এরপরই ক্যাম্পাসে বহিরাগতরা প্রবেশ করতে পারবে না বলে জানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শৈলকুপা থানায় মামলা করে। এরপর এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও বাইরে মহানগর ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দিয়েছে বলে জানা গেছে।

গত ১১ মার্চ বাসের সিটে বসা কেন্দ্র করে গাড়িচালক শরিফুল ও তার সহযোগী রিপনের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয় রাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আল আমিন আকাশের। এরপর স্থানীয় বিনোদপুর বাজারে আকাশসহ রাবির আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ফের কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার মোটরসাইকেল ভাঙচুর এবং শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে ঘটনা বড় হয়ে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়ে। ইট-পাটকেল নিক্ষেপে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলে জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

পরদিন ১২ মার্চ আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মতিহার থানায় মামলা করা হয়। এরপর পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করে। ৬ দফা দাবি মানার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় আন্দোলন স্থগিত করে ক্লাসে ফিরেছেন শিক্ষার্থীরা।

গত মঙ্গলবার সাভারের আশুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেগুনার চালক-সহকারী ও এলাকাবাসীর সংঘর্ষ হয়। যাত্রী পরিবহনকারী লেগুনা পেছন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিলে প্রথমে কথা-কাটাকাটি হয়। পরবর্তী সময়ে সংঘর্ষে জড়ায় শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা। পরে সাভার মডেল থানা ও আশুলিয়া থানা পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। এ ঘটনায় শুক্রবার পর্যন্ত ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে গত ৮ মার্চ।

সূত্র জানায়, অধ্যাপক এ এফ এম আবদুল মঈন নতুন উপাচার্য হয়ে আসার পর বেপরোয়া হন কুবি শিক্ষার্থী খালেদ সাইফুল্লাহ হত্যা মামলায় আত্মস্বীকৃত খুনি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বিপ্লব চন্দ্র দাস। কুবির ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী রানা তার বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সে বিপ্লবকে ভর্তির সুযোগ করে দেন। এরপর গত ৩০ জানুয়ারি রাতে বিপ্লব, মাহি হাসনাইন, স্বজন বরণ বিশ্বাসসহ রেজা-ই-এলাহী সমর্থিত নেতাকর্মীরা কুবির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে উঠতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের বাধা দেন। এ নিয়ে এক সহকারী প্রক্টরের সঙ্গে তাদের বাগবিতণ্ডা হয়। পরে এর জেরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৭ মার্চ এনায়েত উল্লাহ এবং সালমান চৌধুরীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে। পরদিন ৮ মার্চ দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন আল আমিনের দোকানের সামনে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে প্রকাশ্যে মারধর করে গুরুতর আহত করে স্থানীয় ছাত্রদল নেতা রনি মজুমদার, ছাত্রলীগ নেতা বিপ্লব চন্দ্র দাস, ইকবাল খান, কাওসার আহমেদ, স্বজন বরণ বিশ্বাসসহ ১২ থেকে ১৫ ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ কর্মী। হামলার প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর অপসারণসহ পাঁচ দাবিতে আন্দোলনে নামেন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও। এদিকে হামলা ও মারধরের ঘটনায় মামলা করেছেন আহত ছাত্রলীগ নেতা সাইদুল ইসলাম রোহান। তবে এখন পর্যন্ত মামলার আসামি কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি দুই দফায় ১৯ শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন। এরমধ্যে প্রথম দফায় প্রক্টরসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ১৮টি পদ থেকে ১৬ শিক্ষক একযোগে পদত্যাগ করেন। এর এক দিন পরেই চার পদ থেকে পদত্যাগ করেন আরও তিন শিক্ষক। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে নিয়োগ নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে প্রক্টরের দ্বন্দ্ব থেকেই পদত্যাগের ঘটনা। বিষয়টি নিয়ে উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, উপাচার্যের সঙ্গে প্রক্টরিয়াল টিমের মনোমালিন্য চলছিল। এর জের ধরেই প্রক্টরিয়াল টিমের বড় একটি অংশসহ প্রক্টরের আস্থাভাজন শিক্ষকরা একযোগে পদত্যাগ করেছেন।

এর আগে চবিতে চারুকলা ইনস্টিটিউটকে মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের দাবিতে টানা আন্দোলন করে গেছেন শিক্ষার্থীরা। চারুকলা সংস্কারসহ ২২ দফা দাবিতে গত ২ নভেম্বর ক্লাস বর্জন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে ইনস্টিটিউটকে মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের এক দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যান তারা। গত ২২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের সঙ্গে আলোচনার পর আন্দোলন স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ক্লাসে ফেরেন শিক্ষার্থীরা। তবে শর্ত পূরণ না হওয়ায় গত ৩১ জানুয়ারি ফের আন্দোলনে নামেন তারা। এরপর গত ২ ফেব্রুয়ারি ইনস্টিটিউট এক মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ২৮ ফেব্রুয়ারি আরেক ঘোষণায় চারুকলা ইনস্টিটিউট আরও এক মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদত্যাগের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কালবেলাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এতজন কর্মকর্তা একসঙ্গে পদত্যাগ করছে এবং তার পেছনে যেসব কারণ আছে বলে আমরা গণমাধ্যম থেকে জানতে পারছি, সেটি উদ্বেগজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে বিতর্ক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এটি তদন্ত করে দেখা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি কোনো ছাড় দেওয়া হয়, সঠিক মানুষকে নিয়োগ দেওয়া না হয় সেটি নৈতিকভাবে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের সমাজে সার্বিকভাবেই সহিষ্ণুতা কমে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে এসেছে। সে কারণে তারা স্থানীয়দের কাছে অতিথি। স্থানীয়দের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা তৈরি হলে তা দ্রুত মিটিয়ে ফেল উচিত। স্থানীয় রাজনৈতিক বা অন্যান্য অভিভাবক যারা আছেন, তাদের উচিত হবে সমস্যা দ্রুত মিটিয়ে ফেলা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমাধানের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।

ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ায় যারা অপরাধ করে তারাও জানে, তার কিছু হবে না। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংঘাত বাড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তুচ্ছ কারণে সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেও রোধ করতে পারছে না। তবে প্রশাসন যদি ঘটনা ঘটার পর দ্রুত ব্যবস্থা নেয়, সব সময় সক্রিয় থাকে, অনেক সংঘাতই বিস্তৃত হয় না।

রাজধানীর বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শৃঙ্খলা রক্ষায় পরিবেশ রক্ষা কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক আলমগীর।

তিনি বলেন, রাজধানীর বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজনের সম্পৃক্ততা আছে। যে কারণে তুচ্ছ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই পরিস্থিতি এড়াতে পরিবেশ রক্ষা কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। যেই কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বাইরে জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং ক্যাম্পাস-সংশ্লিষ্ট বাজার কমিটির প্রতিনিধিদের রাখতে হবে। এর ফলে অনেক সংঘাত এড়ানো সম্ভব। আবার সংঘাত হলেও দ্রুত না নিরসনও করা যাবে।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com