অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া ঋণ ফেরত না আসা, ডলার ব্যবস্থাপনা এবং সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে দেখা দিয়েছে তারল্য সমস্যা। অধিকাংশ ব্যাংকেই রয়েছে নগদ টাকার সংকট। পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতোমধ্যেই ঋণ ও আমানতের সুদহারের নির্দিষ্ট সীমা তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আমানতের সুদ হার বাড়িয়েও অনেক ব্যাংক কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাচ্ছে না। এ অবস্থায় তারল্য সংকট কাটাতে আগ্রাসী আচরণ করছে তারা। ভবিষ্যৎ বিবেচনা না করে কোনো কোনো ব্যাংক অতি উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। তবে বেশি মুনাফা দেখিয়ে টাকা জমা নিলেও ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি শক্ত না হলে শেষ পর্যন্ত আমানতকারীরা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।
তারা বলছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় ঋণের খুব বেশি চাহিদা বাড়ছে না। ফলে উচ্চ হারে আমানত সংগ্রহ করে ব্যাংকগুলো যদি সঠিকভাবে ব্যবসা করতে না পারে, তাহলে আমানত ফেরত দেওয়া নিয়েই সংশয় তৈরি হতে পারে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘সার্বিকভাবে সুদের হার কিছুটা বাড়ানো যৌক্তিক। তবে কিছু ব্যাংক যেভাবে বেপরোয়াভাবে সুদহার বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহ করছে, সেটা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। দেখা যাবে, দুর্বল ব্যাংকগুলোই বেশি সুদে আমানত নিচ্ছে। এসব ব্যাংককেই একীভূত করার দিকে যেতে হবে।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘১৩ বা ১৪ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করলে সেই টাকা অন্তত ১৬ বা ১৭ শতাংশে ঋণ দিতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় এত বেশি হার সুদে ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। যদি সেটা না পারা যায়, তাহলে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেবে কীভাবে? এমন বাস্তবতায় গ্রাহকদের আমানতে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তাই আমানতকারীদেরও ভালোভাবে বুঝে-শুনে আমানত রাখতে হবে।’
জানা গেছে, ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট কিছুটা কমলেও এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। আবার ঈদ সামনে রেখে অনেকেই ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা তুলছেন। তাছাড়া নানা ধরনের অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ হওয়ায় আমানতকারীদের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এ কারণেও অনেকেই ব্যাংক থেকে তাদের আমানত তুলে নিয়েছেন। অন্যদিকে সরকারও ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এখন উচ্চ সুদে টাকা ধার করছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংকট কাটাতে সাড়ে ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদেও আমানত নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। আবার কোনো কোনো ব্যাংক মেয়াদি আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। সংকটে পড়া কোনো কোনো ব্যাংক আরও বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। কোনো কোনো ব্যাংকে সাড়ে পাঁচ বছরে দ্বিগুণ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আমানত সংগ্রহ করছে। বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের চেয়েও বেশি সুদ পাওয়া যাচ্ছে ব্যাংকের আমানতে। সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এরপরও চাহিদামতো আমানত পাচ্ছে না বেশির ভাগ ব্যাংক। গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে আমানত কিছুটা কমে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংক ঋণের সুদ হার যতটা বেড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে আমানতের সুদ। এরপরও ব্যাংকগুলো কাঙ্ক্ষিত আমানত পাচ্ছে না। টাকার টানাটানি সামলাতে অনেক ব্যাংক প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ধার নিচ্ছে। অন্যদিকে তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণও কমিয়ে দিয়েছে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন ঋণের চাহিদাও অনেক কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে আমানতের প্রকৃত সুদের ঋণাত্মক হার আমানতকারীদের ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত করে। অর্থাৎ ব্যাংকে টাকা রেখে যে সুদ পাওয়া যায়, তা মূল্যস্ফীতির হারেরও অনেক নিচে চলে গেছে। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান না হলে দীর্ঘমেয়াদে সামষ্টিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাই এখন সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য। এ জন্য ঋণের সুদহার বাড়িয়ে টাকাকে দামি করা হচ্ছে। এতে একদিকে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। অন্যদিকে ঋণের পাশাপাশি আমানতের সুদহার বাড়ায় আমানতকারীরা আবার ব্যাংকে ফিরবে— যা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।
ট্রেজারি বিলের সুদহারের ভিত্তিতে এখন ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারিত হচ্ছে। যে পদ্ধতিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, সেটাকে বলা হয় স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল)। প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি মার্চ মাসের জন্য স্মার্ট রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো সাড়ে ৩ শতাংশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাড়ে ৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদহার বাড়াতে পারে। ফলে ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
মূলত ব্যাংক চেয়ারম্যানদের উদ্যোগ ও সরকারি সিদ্ধান্তে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। আমানতের সুদের হার ঠিক করা হয়েছিল সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। তবে ২০২২ সালে ডলার সংকট শুরু হওয়া এবং মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি উঠে যাওয়ায় সুদ হারের সীমা তুলে দেওয়ার পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদরা। শুরুতে বিষয়টি আমলে না নিলেও গত জানুয়ারি থেকেই সুদহারের সীমা তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।