ইস্পাত কঠিন সর্বাত্মক ঐক্যকেই আগামী দিনের আন্দোলনে সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার। কালবেলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, জামায়াতে ইসলামী ইস্যুতে আন্দোলনরত সব শরিক দল শতভাগ ঐকমত্য পোষণ না করলেও চিন্তার দূরত্ব কমে আসছে। শিগগির সম্মিলিত বিরোধীদলীয় যুগপৎ আন্দোলনে আবার কাঁপবে দেশ। সাবেক এই মন্ত্রীর দাবি, জনগণ একটি নতুন সরকার গঠনকল্পে নতুন সংসদ নির্বাচন ঘোষণা করতে বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে বাধ্য করবে। এবার আর তারা পার পাবেন না।
সাক্ষাৎকারে আগামীর আন্দোলন, সরকারের মেয়াদ, নতুন সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনাসহ নানা বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন মোস্তফা জামাল হায়দার।
তৃতীয় ও চতুর্থ জাতীয় সংসদের এমপি মোস্তফা জামাল হায়দার ১৯৪২ সালে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বরইবুনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এরশাদ সরকারের মন্ত্রিসভায় তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এবং যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তাদের মধ্যে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের মোস্তফা জামাল হায়দার ছিলেন অন্যতম।
সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
কালবেলা: সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে এক বছরের বেশি সময় ধরে আপনারা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছেন; কিন্তু আপনাদের দাবি পূরণ ছাড়াই নির্বাচন হয়ে গেল? এ অবস্থায় আগামীতে আপনাদের করণীয় কী?
মোস্তফা জামাল হায়দার : এ কথা সঠিক যে- আমরা ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ, বর্তমান আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের বিলুপ্তি ও একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি অবাধ, জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বিগত ৭ জানুয়ারির সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ভোটারের ডামি নির্বাচন নিঃসন্দেহে এ কথা প্রমাণ করেছে যে, জনগণের রায় শোচনীয়ভাবে ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে গেছে; তারা বিপুলভাবে পরাজিত হয়েছেন। কাজেই আমাদের দাবির যৌক্তিকতা ও যথার্থতা অপরিবর্তিত রয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য আমাদের আন্দোলনও তাই অব্যাহত থাকবে। এটাকে আমরা এক দীর্ঘস্থায়ী প্রলম্বিত লড়াই বলে গ্রহণ করেছি।
কালবেলা: আগামীতে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আপনারা কোন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন?
মোস্তফা জামাল: ঐক্য এবং ইস্পাত কঠিন সর্বাত্মক ঐক্যকেই আগামী দিনের সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে চাই। সেভাবেই আমরা আগামী দিনগুলোতে আমাদের কর্মসূচি নির্ধারণ করতে চাই।
কালবেলা: অনেক দেশ এরই মধ্যে বাংলাদেশের নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মনোভাবও এখন নমনীয় মনে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলের এমন অবস্থানকে কীভাবে দেখছেন?
মোস্তফা জামাল: আমি আগেই বলেছি যে, হাতেগোনা কতিপয় শক্তিবলয় বিশ্বব্যাপী প্রভাব-অঞ্চল সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ন্যায়-অন্যায়, নৈতিকতা-মানবতার পাশ কাটিয়ে দেশে-দেশে নিজ স্বার্থের অনুকূল সরকার ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে সাময়িকভাবে সমর্থন করে থাকে ও কাজে লাগায়; কিন্তু কোনোক্রমেই সেটাকে ন্যায্যতার মানদণ্ডে হৃার্দিক সমর্থন বলা চলে না। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য শুধু রাষ্ট্র হিসেবে চলমান কর্মকাণ্ড ও কূটনৈতিক কার্যধারাকে অব্যাহত রাখার কথা বলেছে।
কালবেলা: বিএনপি ও যুগপতের শরিকদের আন্দোলনের মধ্যেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এবং পরবর্তী সময়ে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সংসদ ও সরকার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মোস্তফা জামাল: নবগঠিত এই সরকার ও সংসদ সম্পর্কে কেবলমাত্র একটি কথাই প্রযোজ্য। গণসম্পৃক্ততাবিহীন গণবিরোধী এই সরকার ও তাদের সংসদ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ ও অকার্যকর হয়ে পড়বে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে জনগণ একটি নতুন সরকার গঠনকল্পে নতুন সংসদ নির্বাচন ঘোষণা করতে বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে বাধ্য করবে।
কালবেলা: সরকারবিরোধী আগামীর আন্দোলন বেগবান করতে শিগগির যুগপতের সম্প্রসারণ হবে কি না?
মোস্তফা জামাল: এই প্রশ্নের সঠিক জবাবের জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। নতুন কর্মকৌশল ও কর্মপন্থা নিয়ে আমরা গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করছি।
কালবেলা: বিগত আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামী ইস্যুতে যুগপতের শরিকদের মধ্যে দুই ধরনের মত ছিল। আগামীর আন্দোলন সামনে রেখে জামায়াত ইস্যুতে ১২ দলীয় জোটের অবস্থান কী হবে?
মোস্তফা জামাল: জামায়াতে ইসলামী ইস্যুতে আন্দোলনরত সব শরিক দল শতভাগ ঐকমত্য পোষণ না করলেও চিন্তার দূরত্ব কমে আসছে। আমি আগেই বলেছি, হয়তো এমন কোনো কর্মপন্থা আমরা উদ্ভাবন করতে সক্ষম হবো—যেন সব বিরোধীদলীয় শক্তির সর্বাধিক কর্মক্ষমতাকে একযোগে কাজে লাগিয়ে বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারকে পর্যুদস্ত করা যায়।
কালবেলা: দ্বাদশ সংসদ বাতিল এবং একদফা দাবিতে বিএনপিসহ যুগপতের শরিকরা আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের পরে যুগপৎভাবে খুব একটা কর্মসূচি দেখা যায়নি। কবে নাগাদ যুগপৎ আন্দোলন ফের মাঠে গড়াতে পারে?
মোস্তফা জামাল: ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে এক দিনের জন্যও বিরোধীদলীয় শক্তি ও জোটসমূহ চুপ করে বসে থাকেনি। বরং আমরা দেখেছি এর আগের নির্বাচনের পরে বিরোধী দলের আন্দোলনে যে সাময়িক Period of Lullness নেমে এসেছিল, এবার তার কোনো লক্ষণ নেই। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দল ভিন্ন ভিন্ন করে হলেও রাজনীতির মাঠ সরগরম করে রাখছে। তবে চূড়ান্ত কিছুর জন্য নির্দিষ্ট সময় বলা একটু কঠিন।
কালবেলা: আওয়ামী লীগের বাইরে যেসব দল, প্রার্থী নির্বাচনে গিয়েছিল তাদের অনেকে সরকারের সমালোচনা করছেন। তাদের বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী? আপনাদের চলমান আন্দোলনে আগামীতে তাদের পাশে চান কি না?
মোস্তফা জামাল: এটা আমাদের জন্য একটা পজিটিভ সাইন। হালুয়া-রুটির আকর্ষণ ও সমঝোতা বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। এতদসত্ত্বেও আমরা এইসব ব্যর্থ মনোরথ বিরাগ-ভাজনদের অবশ্যই কাছে টানতে সচেষ্ট হবো।
কালবেলা: জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সাংগঠনিক অবস্থা কী? আগামীতে দলের শক্তি আরও বাড়াতে কোন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন?
মোস্তফা জামাল: জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সাংগঠনিক অবস্থা দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। বিশেষ করে জাতীয় পার্টির দুই-তিন অংশের মধ্যে এই মুহূর্তে যে ভাঙনের সানাই বেজে উঠেছে, তাতে অচিরেই আমরা অনেক কর্মী-সমর্থক নিয়ে আমাদের সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পারব।
কালবেলা : আপনাকে ধন্যবাদ।
মোস্তফা জামাল : আপনাকে ও কালবেলার পাঠককেও অসংখ্য ধন্যবাদ।