বর্তমানে দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩৫ লাখ ৪০ হাজার শিশু শ্রমজীবী। যার মধ্যে ১৭ লাখ ৮০ হাজার শিশুশ্রমে যুক্ত। শ্রমে থাকা শিশুদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তাদের মধ্যে অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে কাজ করে সবচেয়ে বেশি।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ শীর্ষক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে ১ হাজার ২৮৪টি প্রাথমিক স্যাম্পলিং ইউনিট (পিএসইউ) থেকে ৩০ হাজার ৮১৬টি খানা নির্বাচন করা হয়।
বিবিএসের মহাপরিচালক মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. শহীদুজ্জামান সরকার। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টর তমো পুটিয়ানিন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন খান।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকার শিশুশ্রম নিরসনে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। আশা করা হচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে শিশুশ্রম নিরসন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই এটি খুব স্পর্শকাতর বিষয়। তবে সব কিছু করতে গেলে একটা প্রক্রিয়া দরকার। আমরা আশা করব, এখন দ্রুত কর্মতৎপরতা চালিয়ে দেশ থেকে শিশুশ্রম নিরসন করা সম্ভব হবে।
জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুসারে, পল্লি এলাকায় ২৭ লাখ ৩০ হাজার শ্রমজীবী শিশু রয়েছে এবং শহরাঞ্চলে রয়েছে ৮ লাখ ১০ হাজার। অন্যদিকে, ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা পল্লি এলাকায় ৮ লাখ ২০ হাজার এবং শহরাঞ্চলে ২ লাখ ৪০ হাজার।
প্রতিবেদনে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের জনসংখ্যার পরিসংখ্যান বিষয়ক তথ্য রয়েছে। এ বয়সের মোট শিশু ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬০ হাজার। যেখানে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ। দেশে ২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার খানায় ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শ্রমজীবী শিশু রয়েছে এবং স্কুলে উপস্থিতির হার বর্তমানে ৩৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।
জরিপ অনুযায়ী, শিশু শ্রমিকের ৮২ শতাংশ তাদের নিজস্ব বাড়িতে বসবাস করে, উৎপাদনে ৩৩.৩ শতাংশ এবং কৃষি, বনায়ন এবং মাছ ধরায় ২৩.৬ শতাংশ নিযুক্ত রয়েছে। সামগ্রিকভাবে শিশু কর্মচারী হিসেবে শ্রেণিভুক্ত ৬৮.৮ এবং স্কুলে যায় ৫২.২ শতাংশ।
শিশু শ্রমিকদের গড় মাসিক আয় ৬ হাজার ৬৭৫ টাকা। তিনটি প্রাথমিক সেক্টর যেখানে কৃষি, শিল্প এবং পরিষেবা যথাক্রমে ১০ লাখ ৭০ হাজার, ১১ লাখ ৯০ হাজার এবং ১২ লাখ ৭০ হাজার শিশু শ্রমিক রয়েছে।
সেক্টরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিশুশ্রম: সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ৪৩টি সেক্টরকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে, বিবিএস সরকার ঘোষিত এ ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা থেকে সেক্টরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিশুশ্রম জরিপ-২০২৩ পরিচালনার জন্য পাঁচটি খাত নির্বাচন করেছে। এ সেক্টরগুলোকে লক্ষ্য করে এ জরিপ চালানো হয়।
সেক্টরগুলো ১. মাছ, কাঁকড়া, শামুক/ঝিনুক সংক্ষরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ও শুঁটকি মাছ উৎপাদন। ২. জুতা উৎপাদন (চামড়ার তৈরি পাদুকা শিল্প), ৩. লোহা ও ইস্পাত ঢালাই (ওয়েল্ডিং কাজ বা গ্যাস বার্নার মেকানিকের কাজ), ৪. মোটর যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত (অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ) এবং ৫. ব্যক্তিগত এবং গৃহস্থালি সামগ্রীর মেরামত (অনানুষ্ঠানিক এবং স্থানীয় টেইলারিং ও পোশাক সেক্টর)।
জরিপ অনুযায়ী, এ পাঁচ সেক্টরে ৪০ হাজার ৫২৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩৮ হাজার ৮ জন শিশু কাজ করছে। ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টরে কাজে নিয়োজিত শিশুদের মধ্যে ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ ছেলে এবং ২ দশমিক ৫ শতাংশ মেয়ে শিশু।
এই পাঁচটি সেক্টরে শ্রমজীবী মোট শিশুর সংখ্যা হলো যথাক্রমে শুঁটকি মাছ উৎপাদনে ৮৯৮, চামড়ার জুতা তৈরিতে ৫ হাজার ২৮১টি, ওয়েল্ডিং বা গ্যাস বার্নার মেকানিকের কাজে ৪ হাজার ৯৯, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে ২৪ হাজার ৯২৩ এবং অনানুষ্ঠানিক এবং স্থানীয় টেইলারিং বা পোশাক খাতে ২ হাজার ৮০৫ জন। এ থেকে স্পষ্ট যে, পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ খাতের শ্রমজীবী শিশুদের সবচেয়ে বেশি কাজ করে অটোমোবাইল খাতে। পল্লী ও শহর বিবেচনায় এই খাতে কর্মরত শিশুর ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ পল্লী এবং ৬৪.৩ শতাংশ শহর এলাকায় বসবাস করে।
এ জরিপের মাধ্যমে একটি শ্রমজীবী শিশু ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টরগুলোতে কাজ করার সময় কী কী ধরনের বিপজ্জনক কাজ করতে পারে, তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। আনুমানিক ১৯.১ শতাংশ ছেলে এবং ৭.৭ শতাংশ মেয়েশিশু ভারী বোঝা বহন, মালপত্র টানার কাজে, অধিক উপর বা ফ্লোর থেকে অতি উচ্চতায় উঠে কাজ করে প্রায় ৮.১ শতাংশ ছেলে এবং ০.৩ শতাংশ মেয়ে শিশু।
আইএলওর সহযোগিতায় বিবিএস বাংলাদেশে তার নিজস্ব প্যাটার্নে এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এ জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল ২০২৩ সালের ৩ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত।