যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে ২০১৭ সালে ভারতে শুরু হয়েছিল হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন। সেই ঝড় একে একে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের নানা দেশে। দীর্ঘকাল লজ্জায় গুটিয়ে থাকা বাংলাদেশের নারীরাও যুক্ত হন এই আন্দোলনে। সাহস জুগিয়ে অকপটে বলেন যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা। তবে সে সময় ঝড় তোলা সেই আন্দোলনের ছয় বছর পরও সমাজে রয়ে গেছে যৌন নিপীড়নের প্রবণতা। এখনো প্রভাবশালী, সন্ত্রাসী বা স্বজনদের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ শনিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবস। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে দিবসটি হওয়ায় তা ঘিরে সরকারি-বেসরকারিভাবে দেশের কোথাও কোনো উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় না। তবে দিবসটিকে গুরুত্ব দিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া হলে এ ধরনের অপরাধ নির্মূলে সহায়ক হতো বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন। এ সময় যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেন দুই প্রবাসী বাংলাদেশি নারী। মুহূর্তেই তা ব্যাপক সাড়া ফেলে। প্রতিবাদে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় মানববন্ধনও। বছরের পর বছর ধরে চেপে রাখা সমাজের ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের হাতে কর্মক্ষেত্রে বা বাইরে যৌন নিগ্রহের শিকারের ঘটনা প্রকাশ করাই ছিল এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।
আন্দোলনের মুখে একে একে সামনে আসতে থাকে দেশের ভেতরে ঘটে যাওয়া যৌন নির্যাতনের আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা। সেই ধারাবাহিকতায় জাতীয় দৈনিক পত্রিকার দু-একজন নারী সাংবাদিক সহকর্মীদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একজন সিনিয়র সাংবাদিক ছাড়াও অভিযোগ ওঠে বিখ্যাত প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা, ব্যবসায়ী, নামজাদা শিল্পীসহ অনেকের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু কালবেলাকে বলেন, পাশ্চাত্য, ভারত হয়ে বাংলাদেশেও শুরু হয়েছিল হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন। যারা এখনো যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তারা সাহসিকতার সঙ্গে প্রকাশ্যে অভিযোগ করবেন। আমরা তাদের পাশে দাঁড়াব। এই আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নারী নির্যাতনবিষয়ক এক জরিপ বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ২৩২ নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৪ কন্যাসহ ৪৪ জন। তার মধ্যে তিন কন্যাসহ সাতজন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এক কন্যাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া আট কন্যাসহ ১১ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ৯ কন্যাসহ ১৬ জন।
পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে এক সময় রাজপথে আন্দোলন করেছি। হাইকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করার জন্য খসড়া আইন প্রস্তুত করে কয়েক বছর আগে মানবাধিকার কমিশনকে দেওয়া হয়। এখনো কোনো ফলাফল আমরা দেখতে পারছি না। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কার্যক্রম শুরু করলেও দৃশ্যত এর কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ছে না।
ফেমিনিস্ট নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসিডেন্ট মুশফিকা লাইজু বলেন, আদালতের নির্দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া হাউস এবং করপোরেট অফিসগুলোতে একটি করে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এত বছরেও তা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। তবে জনগণ হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলনের কথা ভোলেননি। যখনই কোনো নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তখনি তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাহসিকতার সঙ্গে তার প্রতি যৌন হয়রানির কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন। সমাজ তাদের খারাপভাবে দেখছে না। কিন্তু ভিকটিম যার কথা প্রকাশ করেছেন তার দিক থেকে ভিকটিম ও তার পরিবারের সদস্যদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে।