করোনা মহামারি বিশ্বব্যাপী দরিদ্রতার হারকে উসকে দিয়েছে। করোনার প্রভাবে ২০২২ সালে বাংলাদেশে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে ২৮ লাখ মানুষ। চলতি বৈশ্বিক মন্দায় দারিদ্র্য পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে। নতুন করে অপুষ্টির শিকার হতে পারে আরও ২ লাখ মানুষ। শুধু বৈশ্বিক মন্দার কারণে বাড়তি ৫০ হাজার মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিতে পারে। বাংলাদেশের নির্বাচন কেন্দ্র করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে তা সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
গতকাল শুক্রবার সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক সম্মেলনে এসব বিষয় উঠে আসে। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করে আন্তর্জাতিক খাদ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইএফপিআরআই। রাজধানীর একটি হোটেলে বিআইডিএসের এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ছয়টি অধিবেশনে প্রায় ৯টি পেপার এবং দুটি পাবলিক লেকচার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) পরিচালক পুনাল ডোরাসের সভাপতিত্বে ‘গ্লোবাল প্রাইস শকস অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি’ শীর্ষক অধিবেশন পরিচালনা করেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. কাজী ইকবাল। এ সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন, বক্তব্য দেন আইএফপিআরআইর সিনিয়র রিসার্স ফেলো ডুনিয়েল রেসনিক, পরিচালক জনস ফ্রোরলো, সিনিয়র সাইনটিস্ট এনজা প্যারাডিসা প্রমুখ। দিনব্যাপী বিভিন্ন অধিবেধনে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান।
আইএফপিআরআইর প্রবন্ধে বলা হয়, করোনা মহামারি বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধির ধারাকে নেতিবাচক পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। স্বাভাবিক সময়ের অর্ধেকের কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০টির বেশি উয়ন্নয়নশীল দেশে। করোনা ও যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক খাদ্য বাজারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। চলতি বৈশ্বিক মন্দা দারিদ্র্য পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে। শুধু বৈশ্বিক মন্দার কারণে বাড়তি ৫০ হাজার মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিতে পারে।
এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে আইএফপিআরআইর জ্যেষ্ঠ গবেষক ডুনিয়েল রেসনিক বলেন, আগামী বছরের শুরুতে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচন ইস্যুতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন যে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বক্তারা বলেন, করোনার সময় ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছিল। এর মধ্যে বড় অংশ হচ্ছে শহরের মানুষ। যারা কাজ হারিয়ে গ্রামে গেছে; কিন্তু সেখানেও কাজ পায়নি। পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্য পরিস্থিতি থেকে পুনরুদ্ধার হওয়া শুরু হলেও শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক মন্দার কারণে দরিদ্র হয়েছে ৫০ হাজার মানুষ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি-২) ক্ষুধা মুক্তি সফল করতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
অপুষ্টিতে ভুগতে পারে আরও ২ লাখ মানুষ: একই অধিবেশনে বিভিন্ন উপস্থাপনায় আরও বলা হয়েছে, নতুন করে অপুষ্টির শিকার হতে পারে আরও ২ লাখ মানুষ। প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনায় নতুন করে অপুষ্টির শিকার হয়েছে ৩১ লাখ মানুষ, যা এ বছর ৩৩ লাখে পৌঁছে যাওয়ার আশঙ্কা করছে সংস্থাটি। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা থাকলে ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন হতে পারে। জিডিপির চেয়ে ক্ষুধার জন্য বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কভিডের কারণে সারা বিশ্বে মানুষের খাদ্য গ্রহণ কমেছে। অনেক পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা ছিল না।
নারীদের অবৈতনিক গৃহকর্মের বার্ষিক মূল্য ৫৩০ কোটি টাকা: সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে আনপেইড কেয়ার ওয়ার্ক শীর্ষক অন্য এক অধিবেশনে নারীদের গৃহস্থালির কার্যক্রমের ওপর বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে এ অধিবেশনে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. বিনায়ক সেন এবং আমেরিকান ইউনিভার্সিটির প্রফেসর তানিয়া আহমেদ। বক্তব্য দেন বিআইডিএসের ড. কাজী ইকবাল, মোহাম্মদ ইউনূস প্রমুখ।
দেশের নারীরা তাদের নিজ বাড়িতে যেসব কাজ করে থাকে, তার বার্ষিক মূল্য ৫৩০ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ১৪.৮ শতাংশ। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে পরিবারের লোকজনের সেবাযত্ন করা, বৃদ্ধদের সেবা করা, রান্না বান্না করা অন্যতম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রীলঙ্কার নারীদের অবৈতনিক গৃহকর্মের বার্ষিক মূল্য তাদের জিডিপির ১৫ শতাংশ আর ২০১৯ সালের হিসাবে ভারতে তা ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশে যে নারীরা শুধু ঘরের কাজ করে তেমনটা নয়। এর পাশাপাশি পুরুষরাও কাজ করে। পুরুষদের এ কাজের অবদান জিডিপির প্রায় ২.৮ শতাংশ।
বিআইডিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, গৃহস্থালি কাজের বিনিময়ে ৭৫ শতাংশ পারিশ্রমিক ধরা হলেও জিডিপিতে আর ১৩ শতাংশ অবদান যুক্ত হতে পারে। যেখানে নারীদের অবদান থাকছে ১১ শতাংশ এবং পুরুষের অবদান ২ শতাংশ। এমনকি ৫০ শতাংশ পারিশ্রমিক দিলেও জিডিপিতে আরও ৮ দশমিক ৮ শতাংশ অবদান বৃদ্ধি পেত। মূলত তারা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর করা ‘টাইম ইউজ সার্ভের’ প্রাথমিক প্রতিবেদন থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এ প্রতিবেদনটি করে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮ শতাংশ স্নাতক বেকার থাকছে: অন্য এক গবেষণায় বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮ শতাংশ স্নাতক বেকার থাকছে। এসব কলেজ থেকে ২০২১ সালে এ হার ছিল ৬৬ শতাংশ। জরিপে বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৪২ থেকে ৪৮ শতাংশই বেকার অবস্থায় রয়েছে। বেকার অবস্থায় থাকাদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি বিএ পাস করেছিলেন। ২৩ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী পলিটিক্যাল সায়েন্স থেকে স্নাতক অর্জন করেছেন। লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্টে এ পাস করেছেন প্রায় ২১ শতাংশ। বেকারদের ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ পাস করেছেন ইসলামের ইতিহাস এবং বাংলায়।
ইংরেজিতে স্নাতক করা শিক্ষার্থীরা কম বেকার রয়েছেন। অর্থনীতি এবং হিসাব বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরাও বেকারত্বের শিকার হয়েছেন কম। সামাজিক বিজ্ঞান এবং ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ের শিক্ষার্থীদের প্রায় ১ শতাংশ বেকার রয়েছেন। দেশের ৬১টি কলেজের ১ হাজার ৩৪০ শিক্ষার্থী এবং ৬১ অধ্যক্ষের সাক্ষাৎকার নিয়ে এ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।