দেখতে দেখতে একেবারে শেষ প্রান্তে অমর একুশে বইমেলা। বিদায়ের সুর বাজছে প্রাণের মেলায়। একুশে ফেব্রুয়ারির পরে বাকি সময়ে মেলায় আসা সিংহভাগই ক্রেতা। গতকালও দেখা গেছে একই চিত্র। মেলায় আসা বেশিরভাগই বই কিনে নিয়ে গেছেন। এতে খুশি লেখক ও প্রকাশকরা। তাদের মতে, এবারের মেলার ভুলত্রুটি আগামী মেলায় শুধরে নেওয়াই হবে আয়োজক কর্তৃপক্ষের প্রধান কাজ।
করোনা মহামারি শেষে এবার পূর্ণ পরিসরে আয়োজিত হয় অমর একুশে বইমেলা। সে কারণে অনেক বেশি আশাবাদী ছিলেন প্রকাশকরা। সে ক্ষেত্রে অনেক প্রকাশনীতে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি, কারও আবার কম বিক্রি হয়েছে। তার পরও করোনার থাবামুক্ত হওয়ার পর মেলায় দর্শনার্থী-পাঠক আসছেন এতেই খুশি লেখক-প্রকাশকরা।
গতকাল বিকেলে দুই ভাই-বোন নিয়ে মেলায় আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিশাত জাহান। তিনি বলেন, এবারের মেলায় আজই প্রথম ও শেষবারের মতো এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস থাকে, পাশাপাশি কোচিংয়ে ক্লাস নিই। সময় করে উঠতে পারি না। আবার দুই ভাই-বোনেরও ক্লাস থাকে বলে তাদেরও নিয়ে আসা হয়নি। তিনি বলেন, মেলা থেকে ভাইকে বিজ্ঞানের একটি বই এবং বোনকে ভূতের গল্পের বই কিনে দিয়েছি। নিজে কিনেছে সাদাত হোসাইনের তোমার নামে সন্ধ্যা নামে ও মৌলি মরিয়মের অলিন্দ অনলে। মেলায় এসে ভালোই লাগছে। আগের চেয়ে অনেকটা গোছানো। তবে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে আরও কাজ করার সুযোগ ছিল মেলা কর্তৃপক্ষের।
মেলায় বিক্রি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেন ভূমি প্রকাশের প্রকাশক জাকির হোসেন। তিনি বলেন, করোনার কারণে দুই বছর পূর্ণ পরিসরে মেলা আয়োজন হয়নি। এবার পুরোদমে মেলা হওয়ায় মেলায় আমাদের স্টলে বিক্রি অনেক ভালো হয়েছে বলতে পারি। মেলার ব্যবস্থাপনাও ভালো ছিল। আশা করি সামনের বছর মেলার আয়োজন আরও সুন্দর করা হবে।
রম্য লেখক সোহাইল রহমানের লেখা ‘গ্রিন কফি’ বই প্রচুর বিক্রি হয়েছে এবারের বইমেলায়। এজন্য এই বইয়ের চারটি মুদ্রণ করতে হয়েছে প্রকাশককে। এসব বিষয় তুলে ধরে তরুণ এই লেখক কালবেলাকে বলেন, লেখক হিসেবে এটা আমার প্রথম বইমেলা। আগে আসা হয়নি, তাই তুলনা করতে পারছি না। তবে এবার প্রথমবার হিসেবে আমার কাছে ভালোই লেগেছে। মাসজুড়ে মেলায় ছিলাম। পাঠকদের অনেক সাড়া পেয়েছি। চেষ্টা করব ভবিষ্যতে আরও ভালো বই লেখার।
মেলায় নতুন বই ১৫৮টি
বইমেলার ২৭তম দিনে মেলায় নতুন বই এসেছে ১৫৮টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে কবিতার বই ৬৭টি। এ ছাড়া গল্পের বই ২৪টি, উপন্যাস ৯টি, প্রবন্ধ ৯টি, গবেষণার বই ৭টি, ছড়ার বই ২টি, জীবনী ৬টি, রচনাবলি ৩টি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই ৩টি, নাটক ৩টি, বিজ্ঞানবিষয়ক বই ২টি, ভ্রমণবিষয়ক বই ২টি, ইতিহাস ৩টি, রাজনীতির বই ১টি, চিকিৎসা/স্বাস্থ্যের বই ২টি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বই ৩টি, রম্য/ধাঁধার বই ১টি, ধর্মীয় বই ২টি, অনুবাদ ৪টি, অভিধান ১টি, সায়েন্স ফিকশন ১টি এবং অন্যান্য বই এসেছে ৩টি।
বইমেলার অনুষ্ঠান
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববাঙালির সাহিত্য শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আলম খোরশেদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন এ এফ এম হায়াতুল্লাহ, আ. আল মামুন এবং জসিম মল্লিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন জাহিদ মুস্তাফা, মুমিত আল রশিদ, ফরিদ আহমদ দুলাল ও আরেফিন রব।
হুমায়ুন আজাদকে স্মরণ
বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর মৌলবাদী চক্রের সন্ত্রাসী হামলার বার্ষিকীতে ‘হুমায়ুন আজাদের দিবসের ডাক—পাইরেসিমুক্ত বইমেলা চাই’—এই প্রতিপাদ্যে একুশে বইমেলায় গতকাল বিকেল ৫টায় তাকে স্মরণ করা হয়। লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের যৌথ উদ্যোগে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের তথ্যকেন্দ্রের সামনে আয়োজিত এ সভার শুরুতে তার স্মরণে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সভায় বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি আসলাম সানী, কবি মোহন রায়হান, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন, হুমায়ুন আজাদের ভাই সাজ্জাদ কবীর, বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. শাহাদাৎ হোসেন নিপু প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন আগামী প্রকাশনীর নির্বাহী ওসমান গনি।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন রোকেয়া ইসলাম, শেখর বরণ, সৌম্য সালেক, খসরু পারভেজ, সুবর্ণ আদিত্য, জান্নাতুল ফেরদৌসী এবং থিউফিল নকরেক। আবৃত্তি পরিবেশন করেন সাইমুন আনজুম ইভান, সিদ্দিকুর রহমান পারভেজ, অনন্যা রেজওয়ানা এবং ফারহানা তৃর্ণা। এ ছাড়া ছিল মিলন কান্তি দের রচনা ও নির্দেশনায় দেশ অপেরা যাত্রাপালার পরিবেশনা ‘বঙ্গবন্ধুর ডাকে’। সংগীত পরিবেশন করেন ডা. রেজাউর রহমান, মো. আলী হোসাইন, মীর তারিকুল ইসলাম, পল্লবী সরকার মালতী, ঝরনা রায় ভাবনা, মুন্নি কাদের, আঁখি আলম, আরিফ বাউল, কামাল আহমেদ, মো. আরিফুর রহমান চৌধুরী। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন গৌতম মজুমদার (তবলা), ডালিম কুমার বড়ুয়া (কি-বোর্ড), মো. হাসান আলী (বাঁশি) এবং মো. ফারুক (অক্টোপ্যাড)।
আজ মঙ্গলবার, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে বইমেলা ও অনুষ্ঠানমালার সমাপনী দিন। বিকেল ৫টায় সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা ভাষণ দেবেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। অনুষ্ঠানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২, কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ এবং অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ উপলক্ষে বিভিন্ন গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হবে।
গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩
সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০২২ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশের জন্য আগামী প্রকাশনীকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করা হবে। ২০২২ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে শৈল্পিক ও গুণমান বিচারে সেরা বই বিভাগে আহমদ রফিক রচিত বিচ্ছিন্ন ভাবনা প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুকস, মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ রচিত বাংলা একাডেমি আমার বাংলা একাডেমি বইয়ের জন্য ঐতিহ্য এবং হাবিবুর রহমান রচিত ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা প্রকাশের জন্য পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেডকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হবে। ২০২২ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ময়ূরপঙ্খিকে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করা হবে।
এবারের বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুথিনিলয় (প্যাভিলিয়ন), নবান্ন প্রকাশনী (২-৪ ইউনিট), উড়কিকে (১ ইউনিট) শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করা হবে। সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রয়েছে সমাপনী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।