চাঁদে অভিযানের সাফল্যের পর এবার সূর্যের দিকে যাত্রা শুরু করেছে ভারতীয় মহাকাশযান আদিত্য-এল-১। সূর্যের কক্ষপথে পরিভ্রমণ ও এ-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করবে আদিত্য। স্থানীয় সময় গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটা শহরের লঞ্চপ্যাড থেকে নভোযানটি উৎক্ষেপণ করা হয়। খবর এনডিটিভি ও আনন্দবাজার অনলাইনের।
এই শ্রীহরিকোটা লঞ্চপ্যাড থেকেই গত ১৪ জুলাই চাঁদের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল চন্দ্রযান-৩। যাত্রার ৩৯ দিন পর গত ২৩ আগস্ট চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণে সক্ষম হয় মহাকাশ যান বিক্রম। সেই সাফল্যের ২ সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে সূর্যের কক্ষপথে আদিত্যকে পাঠাল ভারত।
সৌরজগতের প্রাণকেন্দ্র সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব ১৪ কোটি ৯৬ লাখ কিলোমিটার। পৃথিবী থেকে উড়াল দেওয়ার পর ১৫ লাখ কিলোমিটার পর্যন্ত যাবে আদিত্য। শতকরা হিসেবে যা পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের ১ শতাংশ পথ।
এই অভিযানের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা ভারতের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইসরো জানিয়েছে, এই পথ পাড়ি দিতে আদিত্য সময় নেবে চার মাস। সংস্কৃত ভাষায় সূর্যের আরেক নাম আদিত্য। এ কারণে মহাকাশযানটির নাম সূর্যের নামেই রাখা হয়েছে। আর এল-১ হলো লেগ্রেঞ্জ পয়েন্ট ১-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ১৫ লাখ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর যেখানে গিয়ে থামবে আদিত্য, সেই এলাকাটি হলো সূর্যের লেগ্রেঞ্জ পয়েন্ট।
ইউরোপের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সংজ্ঞানুযায়ী, লেগ্রেঞ্জ পয়েন্ট হলো মহাবিশ্বের এমন একটি এলাকা, যেখানে দুই বৃহৎ মহাজাগতিক বস্তু, অর্থাৎ সূর্য ও পৃথিবীর মহাকর্ষীয় শক্তি পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। আদিত্য যদি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে, তাহলে পৃথিবী যে গতিতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে সেই একই গতিতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে সক্ষম হবে মহাকাশযানটি।
ইসরো জানিয়েছে, শ্রীহরিকোটার লঞ্চপ্যাড থেকে উৎক্ষেপণের পর লেগ্রেঞ্জ পয়েন্টে যাওয়ার আগে বেশ কয়েকবার পৃথিবীর কক্ষপথে পরিভ্রমণ করবে আদিত্য। এতে সূর্যের কক্ষপথে পৌঁছাতে সুবিধা হবে যানটির। উৎক্ষেপণের পর প্রায় ১৬ দিন পৃথিবীর চারদিকে পাক খাবে আদিত্য। এই ১৬ দিনে সূর্যের দিকে পাড়ি দেওয়ার জন্য পাঁচটি ধাপে গতিবেগ বাড়াবে আদিত্য। এরপর ১১০ দিন সূর্যের অভিমুখে যাত্রা করে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করবে সেটি। এই লেগ্রেঞ্জ পয়েন্টে সূর্য এবং পৃথিবীর আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ বল একসঙ্গে ক্রিয়াশীল। ফলে এই অঞ্চলে পৌঁছে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থির থাকতে পারে।
লেগ্রেঞ্জ পয়েন্টে পৌঁছানোর পর সূর্যের তিন স্তর সোলার করোনা (সূর্যের বহিরাবরণ) ফটোস্ফেয়ার (সূর্যের পৃষ্ঠ, খালিচোখে পৃথিবী থেকে আমরা এই অংশটি দেখি) এবং ক্রোমোস্ফেয়ার (ফটোস্ফেয়ার ও সোলার করোনার মধ্যবর্তী অর্ধতরল স্তর) পর্যবেক্ষণ ও এ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করবে আদিত্য। এই কাজের জন্য নভোযানটি প্রয়োজনীয় ৭টি পেলোড (বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম) নিয়ে যাচ্ছে। লেগ্রেঞ্জ পয়েন্ট পৌঁছানোর পর ভিসিবল এমিশন লাইন করোনাগ্রাফি (ভিইএলসি) পেলোড প্রতিদিন ১ হাজার ৪৪০টি ছবি তুলে পাঠাবে। তাই এই পেলোডটিকেই আদিত্য-এল১-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পেলোড বলে মনে করা হচ্ছে।
এই অভিযানে ব্যয় কত হয়েছে, সে সম্পর্কিত কোনো তথ্য দেয়নি ইসরো। তবে সরকারি সূত্রে জানা গেছেÑ অভিযানের বাজেট ধরা হয়েছে ভারতীয় মুদ্রায় ৩৭৮ কোটি রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৯৯ কোটি ২৪ লাখ ৬৯ টাকা)।
উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালে জাপান সূর্যের কক্ষপথে প্রথম মহাকাশযান পাঠিয়েছিল। সেই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল সূর্যের আকার-আয়তন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেওয়া। এরপর ১৯৯০ সাল থেকে সূর্য অভিযান সংক্রান্ত গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল অ্যারোনেটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) এবং ইউরোপের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ)। তাদের এই তৎপরতায় সাফল্য আসে ৩০ বছর পর, ২০২০ সালে। ওই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে নাসা ও ইএসএ যৌথভাবে সূর্যের কক্ষপথে একটি যান পাঠাতে সক্ষম হয়। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পর চতুর্থ দেশ হিসেবে সূর্যের কক্ষপথে যান পাঠাল ভারত।
মন্তব্য করুন