৫ আগস্ট-পরবর্তী ইতিবাচক রাজনীতির বার্তার বাইরেও নেতাকর্মীদের নেতিবাচক কাজে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্ররাজনীতি, গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদলের ভূমিকা, ছাত্রলীগ পুনর্বাসনের অভিযোগসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমজাদ হোসেন হৃদয়
কালবেলা: ছাত্রদল বর্তমানে কোন বিষয়ে প্রাধান্য দিচ্ছে?
নাছির উদ্দীন নাছির: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আমাদের সাংগঠনিক কাঠামো গঠন এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে রক্ষা করে রাজনীতি করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। ৫ আগস্টের পর আমাদের প্রধান ফোকাস ছিল আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে যাব। তারা কী চায়, কেমন রাজনীতি প্রত্যাশা করে, সেই মতামত নেওয়া। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী যে ইতিবাচক রাজনীতির ধারায় আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্রদলে অংশীদারত্ব করতে চেয়েছি। ৪০-৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে আমি নিজে কথা বলেছি। শিক্ষার্থীরাও ইতিবাচক রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে। ছাত্রদল যাতে ইতিবাচক রাজনীতিতে থাকে, সে প্রত্যাশাও তারা ব্যক্ত করেছেন। পরবর্তী সময়ে আমরা ছাত্রদলকে ৩৮টি টিমে বিভক্ত করে বাংলাদেশের আড়াই হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাংগঠনিক কাঠামো গঠন করেছি। এখন পর্যন্ত ৯০০-এর অধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কমিটি গঠন করেছি। যেটা আমরা গত ১৬-১৭ বছর ধরে পারিনি। শিক্ষার্থীদের মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করতে ভবিষ্যতে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করব।
কালবেলা: ছাত্ররাজনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ভীতি আছে। ৫ আগস্টের পর রাজনীতি করতে গিয়ে আপনারা কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কি না?
নাছির উদ্দীন নাছির: অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীরা ট্রমাটাইজের (মানসিক আঘাত) মধ্য দিয়ে গিয়েছে, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রম দেখেছে। সে কারণে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ভীতি থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এটা যেমন সত্য, আরও সত্য একটি পক্ষ শিক্ষার্থীদের ভীতিকে পুঁজি করে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার জন্য আন্দোলন করেছে। পরে দেখা গেছে একদিকে তারা মানববন্ধন করেছে, অন্যদিকে গোপনে কমিটি গঠন করে তারা রাজনীতি করছে। আমরা এ ধরনের রাজনীতি করতে চাই না। গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা চেয়েছি প্রতিটি ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে গণতান্ত্রিক রাজনীতি থাকা উচিত। আমরা শিক্ষার্থীদের আমাদের ইতিবাচক রাজনীতির দিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, শিক্ষার্থীরা চাইলে সেটি গ্রহণ করতে পারে, চাইলে গ্রহণ নাও করতে পারে। আমরা কাউকে কোনো জোরজবরদস্তি করছি না। কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে আমরা বাধার সম্মুখীন হয়েছি। কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যদি রাজনীতি করতে না চান, সেটিকেও আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে নিচ্ছি। কিন্তু এটাকে হাসিল করতে গিয়ে একটি গোষ্ঠী নিজেরা রাজনীতি করছে, আবার প্রকাশ্যে রাজনীতির বিষয়ে প্রোপাগান্ডা তৈরি করছে। সেগুলোও আমরা সচেতনভাবে শিক্ষার্থীদের জানাচ্ছি।
কালবেলা: ঢাবি ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদলের সাংগঠনিক গতিশীলতা কম পরিলক্ষিত হচ্ছে, এর কারণ কী?
নাছির উদ্দীন নাছির: ৫ আগস্টের পর ছাত্ররাজনীতি নিয়ে প্রোপাগান্ডা হয়েছে। সেগুলো কাটিয়ে আমরা ইতিবাচক রাজনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের মতামতকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখে হলগুলোতে আমরা আমাদের সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলিনি। যেহেতু গতানুগতিক রাজনীতি পরিহার করতে হবে, সেজন্য শোডাউনের রাজনীতি ছাত্রদলের পক্ষ থেকে সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সবগুলো বিষয় হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে। আমরা আসলে সবকিছু ধীরে ধীরে করতে চাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের চাওয়াকে প্রাধান্য রেখে রাজনীতি করতে চাওয়ার কারণেই হয়তো মনে হচ্ছে আমাদের সাংগঠনিক কাজ কম হচ্ছে।
কালবেলা: ছাত্রদলও ছাত্রলীগের মতো গেস্টরুম রাজনীতিতে ফিরবে, এমন একটি ন্যারেটিভ শোনা যায়। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
নাছির উদ্দীন নাছির: দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে গেস্টরুম কালচারের মাধ্যমে ভয়াবহ নির্যাতনের যে চিত্র বিগত সময়ে ছিল, এটি চিরতরে বন্ধ হবে। জোর করে মিছিলে নেওয়া, গেস্টরুম নির্যাতন, এটি বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে আর থাকবে না বলে আমরা শতভাগ নিশ্চিত করছি। যদি বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল তারাও এটা করতে পারে। এমনটি বলে শিক্ষার্থীদের এক ধরনের বিভ্রান্ত করছে একটি পক্ষ। আমরা শিক্ষার্থীদের শতভাগ আশ্বস্ত করতে চাই, গণঅভ্যুত্থানের পর ইতিবাচক রাজনীতির প্রতি আমরা সচেতন রয়েছি। সে সচেতনতার কারণ হিসেবে আমরা মনে করছি যে, বাংলাদেশে আর কখনোই গেস্টরুম কালচারের মতো ভয়াবহ রাজনীতি আসবে না, জোর করে মিছিলে নেওয়া হবে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলার রাজনীতি আর কখনোই আসবে না।
কালবেলা: ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদলের বক্তব্য কী, ফল পক্ষে আসবে বলে মনে করেন কি?
নাছির উদ্দীন নাছির: আমরা ডাকসু চাই, এ নিয়ে আমাদের কোনো দ্বিধাবোধ নেই। প্রশাসন কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের কাছে লিখিত প্রস্তাবনা চেয়েছে। ছাত্রদলসহ প্রায় সবকটি ছাত্র সংগঠনই লিখিত প্রস্তাবনা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে যদি ইমপ্লিমেন্ট (বাস্তবায়ন) করে, তাহলে তো প্রভাব পড়বে। তারপরই ডাকসু নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবেন। কিন্তু ২০১৯ সালের মতো ডাকসু হলে সেটা খুব বেশি কল্যাণকর হবে বলে আমরা মনে করছি না। আর ছাত্রদল যেসব নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, সেগুলোতেই ইতিবাচক ফল অর্জন করেছে। এবারও যদি সময় নিয়ে ডাকসু নির্বাচন করা হয়, সেক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল অত্যন্ত আশাবাদী।
কালবেলা: ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকর্মীরা স্থান পাচ্ছে বলে অভিযোগ আছে, এ বিষয়ে আপনাদের বক্তব্য জানতে চাই।
নাছির উদ্দীন নাছির: অতীতে ছাত্রলীগ করেছে—এরকম কাউকে আমরা পদে আনছি না। ছাত্রলীগ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব রাজনীতি করেছে ব্যাপক পরিসরে। তখন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন সাধারণ শিক্ষার্থীরও ছবি ছিল। পরবর্তী সময়ে আমরা যাদের পদ দিয়েছি, দেখা গেছে ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের ছবি রয়েছে। সে সংখ্যা খুবই কম। তারপরও ছাত্রলীগের পদধারী কেউ কেউ চলে এসেছে। আমরা যাচাই-বাছাই করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আমাদের শক্ত অবস্থান আছে। ছাত্রলীগ পুনর্বাসনের কোনো সুযোগ নেই।
কালবেলা: ছাত্রদলের বর্তমান কমিটি ভেঙে যাচ্ছে বলে গুঞ্জন আছে, বাস্তবতা আসলে কী?
নাছির উদ্দীন নাছির: কমিটি ভাঙছে কি না—এমন তথ্য আমার কাছে নেই। এটি প্রোপাগান্ডা হতে পারে। ছাত্রদলের কমিটি গঠন কিংবা বিলুপ্ত এসবের সিদ্ধান্ত একমাত্র ছাত্রদলের সর্বোচ্চ সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমান নিয়ে থাকেন। উনি যখন মনে করবেন ছাত্রদলের এই কমিটি দরকার নেই, তখন ব্যবস্থা নেবেন। এখন পর্যন্ত এমন কোনো পরিস্থিতি আমরা দেখছি না। বরং আমরা দলের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে ইতিবাচক রাজনীতি করে যাচ্ছি এবং সংগঠনকে গতিশীল রাখার চেষ্টা করছি। ছাত্ররাজনীতিতে ছাত্রদলকে আমরা ইতিবাচক রোল মডেল হিসেবে তৈরি করতে কাজ করছি।
কালবেলা: কিছু কিছু জায়গায় ছাত্রদল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানান অপকর্মের খবর আসছে, এ বিষয়ে আপনাদের নির্দেশনা কী?
নাছির উদ্দীন নাছির: কিছু ঘটনা ঘটছে, সেটা অস্বীকার করছি না। নেতাকর্মীরা ভুল করছেন। কিন্তু আমরা দেখছি, ভুলত্রুটির বিপরীতে তাদের দোষগুলোকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং কিছু কিছু গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করছে। অনেক নিউজ সত্য নয় বলে আমরা তদন্ত করে দেখেছি। তারপরও আমরা শক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছি। যার ফলে নেতাকর্মীদের ভুলত্রুটির সংখ্যা কমে আসছে। আমরা কঠিন নির্দেশনা দিচ্ছি। আমরা শৃঙ্খলার বিষয়ে জিরো টলারেন্স পলিসির মধ্যে রয়েছি।
কালবেলা: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদলের ভূমিকা কি আড়ালে পড়েছে মনে করেন?
নাছির উদ্দীন নাছির: জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্রদলের অবদান অনেকেই স্বীকার করছেন না। তারা ছাত্রদলকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন। তারা মনে করছেন, ক্রেডিট যদি ছাত্রদলকে দিয়ে দিই, তাহলে তারা যে অবস্থানের মধ্য দিয়ে দল গঠন করল, সেই দলের প্রতি প্রভাব বিস্তার করবে ছাত্রদল বা বিএনপি। সে কারণে তারা ক্রেডিট দিচ্ছে না। তবে আমরা যে অংশগ্রহণ করেছি, এটা দেশের মানুষ, শিক্ষার্থীরা জানেন। একশর অধিক নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, আমরাও তালিকা করেছি। অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন এই তালিকা প্রকাশই করতে পারেনি।
কালবেলা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
নাছির উদ্দীন নাছির: কালবেলাকেও ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন