দেশের স্বাস্থ্য খাতে সেক্টরভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে বের হয়ে প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেক্টর কর্মসূচি থেকে বের হয়ে যেসব অত্যাবশ্যকীয় খাতে ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে, সেগুলো নিয়ে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত দুই বছরের জন্য ডিপিপি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমানে যে জনবল রয়েছে, তা দিয়ে এনজিওর সহযোগিতায় কাজগুলো পরিবীক্ষণ ও সমন্বয় করতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) কাজগুলো মূল কাঠামোতে আনতে জনবল, ওষুধ, এমএসআর, টিকা, জরুরি পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবা, যন্ত্রপাতি, যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানি ইত্যাদি বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের পরিচালন বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ২০২৪ থেকে ২০২৯ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর (পঞ্চম এইচপিএনএসপি) এক্সিট প্ল্যান বিষয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত ৬ মার্চের এ সভার কার্যবিবরণী থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় সরকারের অর্থ বিভাগ, ইআরডি, পরিকল্পনা কমিশন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, গ্যাভিসহ সব দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
তখন ৩১ মার্চের মধ্যে এই ডিপিপি কোনোভাবেই প্রণয়ন করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছিলেন একাধিক কর্মকর্তা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের দুজন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের বলা হয়েছে, পঞ্চম এইচপিএনএসপির আরডিপিপি সংক্ষিপ্ত করে দুই বছরের ডিপিপি তৈরি করতে; সেটি একটি অসম্ভব বিষয়। কারণ, সেক্টর কর্মসূচিতে প্রতি বছরের জন্য পৃথক কর্মপরিকল্পনা সাজানো হয়, যা সংক্ষেপ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, নতুন করে দুই বছরের প্রকল্প মাত্র তিন সপ্তাহে প্রণয়ন করাও অসম্ভব।
৩১ মার্চ সময় বেঁধে দেওয়া থাকলেও এই ডিপিপি এখন পর্যন্ত (২২ এপ্রিল) প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে।
সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, চতুর্থ সেক্টর কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতে অব্যাহত সেবা প্রদানে যুক্ত অত্যাবশ্যকীয় জনবল ওষুধ, যন্ত্রপাতি, এমএসআর, যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ, সিকিউরিটি ইত্যাদি চিহ্নিত করে দুই বছরের জন্য প্রয়োজনীয় ডিপিপি প্রণয়নের মাধ্যমে এক্সিট প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হবে। এ পরিস্থিতিতে সেক্টর কর্মসূচি থেকে বের হয়ে মূল কাঠামোতে যেতে জনবলের বিষয়টি পুনর্বিন্যাস করার পাশাপাশি টিকা ও রোগ নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত কেনাকাটার সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
সভার সিদ্ধান্তে বলা হয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৯ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর প্রোগ্রাম অনুমোদন প্রক্রিয়া না করা এবং সেখান থেকে বের হয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যেসব অত্যাবশ্যকীয় খাতে ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে যেমন ওষুধ, যন্ত্রপাতি, এমএসআর, যানবাহন, রক্ষণাবেক্ষণ, সিকিউরিটি ইত্যাদির জন্য জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৬ দুই বছরের জন্য ডিপিপি প্রণয়ন করা হবে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট, কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর, নিপোর্ট, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের জন্য পৃথক প্রকল্প নিতে হবে। যা নিজ নিজ অধিদপ্তর থেকে ৩১ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা বলা হয়। জনবলের বিষয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ করতে হবে যে, দুই বছর পরে তারা কোনোভাবেই চাকরিতে বহাল থাকবে না। বিশ্বব্যাংকে ৩৭৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ এবং জিএফএফের ২৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান পেতে একটি বা দুটি প্রকল্প নিতে হবে। এডিবির ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার বিষয়ে আলোচনা করে, তাদের কারিগরি সহায়তায় প্রকল্পের ডিজাইন করতে হবে। এ ছাড়া আরবান হেলথের জন্য আলাদা প্রকল্প নিতে হবে।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিসহ এ জাতীয় যেসব কাজ জিওবি এবং উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে পরিচালিত, সেগুলো স্বাস্থ্যসেবার মূল কাঠামোতে আনতে হবে। বর্তমান সেটআপ অনুযায়ী যে জনবল রয়েছে, তা দিয়ে এনজিওর সহায়তায় কাজগুলো পরিবীক্ষণ ও জোরদার করতে হবে।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে দক্ষ, সাশ্রয়ী ও সমন্বিতভাবে পরিচালনার জন্য ১৯৯৮ সাল থেকে সেক্টর কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হয়। এ পর্যন্ত চারটি সেক্টর কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। চতুর্থ সেক্টর কর্মসূচি ২০২৪ সালের জুনে শেষ হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৯ মেয়াদ বাস্তবায়নে পঞ্চম সেক্টর কর্মসূচির জন্য ১ লাখ ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকার পিআইপি (পারফরম্যান্স ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যান) নির্ধারণ করা হয়। এমনকি সেটি বাস্তবায়নে ৬০টি সভাও হয়। কিন্তু বিগত সরকারের সময়ে করা এই প্রকল্প শেষ পর্যন্ত বাতিল করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির বলেন, বর্তমান সরকার পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনার পরিবর্তে দুই বছর মেয়াদি প্রকল্প গ্রহণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি যথাযথ নয়। এ ক্ষেত্রে এরই মধ্যে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে, যেমন দুই বছরের প্রকল্প, যেখানে আট মাস এরই মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরিতে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ৩১ মার্চ পর্যন্ত। এ স্বল্পতম সময়ে এটা করা অসম্ভব। পাঁচ বছরের কাজ দুই বছরে আনলে জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি ঝুঁকিতে পড়বে, হাসপাতালে রোগী বাড়বে, সেবা কমবে, মানুষের দরিদ্রতা বাড়বে। সর্বোপরি দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটবে।
এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে) অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, আমরা চাচ্ছি দাতা নির্ভর সেক্টর প্রোগ্রাম থেকে বেরিয়ে রাজস্ব খাতের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করতে।
মন্তব্য করুন