সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একজন প্রকল্প পরিচালকের সম্পদের বহর ও ব্যাংক হিসাবের লেনদেন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা। তার ৯৪টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয়েছে প্রায় ১২৮ কোটি টাকা। তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে প্রায় ৩৩ কোটি টাকার। আলোচিত ওই কর্মকর্তার নাম মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের কক্সবাজার জোন অফিসের মাতারবাড়ী আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফ্রেন্ড পাওয়ার প্রজেক্টের (আরএইচডি) প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও সওজ প্রধান কার্যালয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (রিজার্ভ) হিসেবে কর্মরত। দুদুক এরই মধ্যে তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে এবং বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। শিগগির কমিশনে তার বিরুদ্ধে দুটি পৃথক মামলার সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
প্রাপ্ত নথি থেকে জানা গেছে, জাহাঙ্গীর আলম তার আয়কর নথিতে দেখিয়েছেন ৪ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার ৭৪৩ টাকার সম্পদ। এর মধ্যে দুদকের অনুসন্ধানে তার গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া গেছে ৩ কোটি ১১ লাখ ১০ হাজার ১৯২ টাকা। অনুসন্ধানকালে দুদক জাহাঙ্গীর আলমের ২৯ কোটি ২৫ লাখ ১৮৪ টাকার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ থাকার প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে।
জানা গেছে, জাহাঙ্গীর আলমের বৈধ আয়ের খাত অনুযায়ী সম্পদ বিবরণীতে দেখা যায়, তার অতীত সঞ্চয় ৪১ লাখ ৫৪ হাজার ৬২৪ টাকা। বেতন থেকে আয় ৮২ লাখ ৪৩ হাজার ৯৭৯ টাকা। ব্যাংক সুদ থেকে আয় ১ কোটি ৩০ লাখ ২৯ হাজার ৩৩ টাকা। করমুক্ত আয় ৩৮ লাখ ৪০ হাজার ৪৭৫ টাকা। রেমিট্যান্স থেকে আয় ২ লাখ ৭১ হাজার ৫২১ টাকা। মূলধনি আয় ১২ লাখ ৫৫ হাজার ৫৬০ টাকা। দায়-দেনা ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা। তার বৈধ মোট সম্পদ ৩ কোটি ১১ লাখ ১০ হাজার ১৯২ টাকা।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, মো. জাহাঙ্গীর আলমের বিষয়ে অনুসন্ধানকালে বিভিন্ন রেকর্ডপত্র সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করা হয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, জাহাঙ্গীর আলম মোট ৪৯ লাখ ৬৩ হাজার ৬৫০ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ এবং ৩১ লাখ ২ হাজার ৪৫৯ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট ৩১ কোটি ৪৯ লাখ ৬৬ হাজার ১০৯ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন করে ভোগদখলে রেখেছেন। এ সময় তার পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয় পাওয়া যায় ৬৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৭ টাকা। এই ব্যয়সহ তার নিট সম্পদের পরিমাণ ৩২ কোটি ১৮ লাখ ২১ হাজার ৬৪৬ টাকা। অন্যদিকে, তার নামে প্রাপ্ত গ্রহণযোগ্য বৈধ উৎসের পরিমাণ ৩ কোটি ১১ লাখ ১০ হাজার ১৯২ টাকা। তিনি ২৯ কোটি ৭ লাখ ১১ হাজার ৪৫৪ টাকা তার আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। এই জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও ভোগ-দখলে রেখে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৯৪টি হিসাবে ১২৭ কোটি ৩৫ লাখ ১৩ হাজার ২২৬ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন। যার পক্ষে বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। তিনি এই অবৈধ অর্থ বারবার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রদান ও উত্তোলনের মাধ্যমে সন্দেহজনক লেনদেন করে লেয়ারিং করেছেন। অর্থের উৎস গোপন করার মাধ্যমে বৈধ করার ছদ্মাবরণে এ অর্থের হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে অর্থের অবস্থান গোপনপূর্বক ছদ্মাবরণে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২), (৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, জাহাঙ্গীর আলম অসাধু উপায়ে ২৯ কোটি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৯৪টি হিসাবে মোট ৭৮ কোটি ৮৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩০৩ টাকা জমা ও ৪৮ কোটি ৪৭ লাখ ৭৯ হাজার ৯২৩ টাকা তুলে নিয়েছেন। তার হিসাবে সর্বমোট ১২৭ কোটি ৩৫ লাখ ১৩ হাজার ২২৬ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে। ২০১২ সালের ৪ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ১৪ মে পর্যন্ত সময়ে তিনি এসব লেনদেন করেছেন। ব্র্যাক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও আইডিএলসি ফাইন্যান্সে এসব হিসাব খোলা ও লেনদেন করা হয়েছে।
এসব টাকা দফায় দফায় বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রদান ও উত্তোলনের মাধ্যমে সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন। অর্থ লেনদেনের লেয়ারিং ঘটিয়ে অর্থের উৎস গোপন করার মাধ্যমে বৈধ করার অপচেষ্টা করেন। এসব অর্থের হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে অর্থের অবস্থান গোপনপূর্বক ছদ্মাবরণে তা বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে তিনি দুদক আইন ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
জাহাঙ্গীর আলমের বিষয়ে বিএফআইইউর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী তার ব্যাংক বিবরণীতে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে প্রকল্প পরিচালক হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তার নামে বেতন-ভাতা বাবদ জমা হয়েছে ৯৮ লাখ টাকা। অথচ তার নামে ৭৭টি এফডিআরসহ মোট ৮২ আমানত হিসাবে (৫টি সঞ্চয়ী ও ৭৭টি স্থায়ী আমানত) লেনদেন হয়েছে ১২৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
জানা গেছে, ২০১২ সালের ২১ নভেম্বর ব্র্যাক ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন জাহাঙ্গীর আলম। বিভিন্ন সময় এ হিসাবে ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা জমা হওয়ার পর সব টাকাই তুলে নেওয়া হয়েছে। তিনি গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের করপোরেট শাখায় আরেকটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর। এই হিসাবে বিভিন্ন সময় ১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা জমা করার পর তা তুলে নেন। ২০২১, ২০২৩, ২০২৪ সালে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি গুলশান করপোরেট শাখায় ১৮টি এফডিআর এবং একটি সঞ্চয়ী হিসাব খুলে জমা করেন ৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। সমপরিমাণ টাকা এসব হিসাবে জমা আছে। ২০১২ সালে জাহাঙ্গীর আলম আরেকটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রগতি সরণি শাখায়। এই হিসাবে ৩৮ কোটি টাকা জমা করা হয়। তুলে নেওয়া হয়েছে ৩৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ১১টি এফডিআর এবং ডিপিএস হিসাব খুলে ৮ কোটি ৮ লাখ টাকা জমা করা হয়। সমপরিমাণ টাকা জমা আছে। ২০২৪ সালের জুন-জুলাইয়ে আইডিএলসি ফিন্যান্স পিএলসি উত্তরা শাখায় ৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকার ১৭টি এফডিআর করেন তিনি। এসব টাকার স্থিতি আছে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ১৩ কোটি ৮ লাখ টাকার ৩১টি এফডিআর করেছেন ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স পিএলসি গুলশান শাখা এবং প্রিন্সিপাল শাখায়। এগুলো এখনো স্থিতি আছে। ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের রাজশাহী, গোপালগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও এবং ঢাকার বারিধারা শাখায় খোলা হিসাবে ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা জমা করে তা তুলে নেন জাহাঙ্গীর আলম। এসব হিসাবে তিনি মোট ১২৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা লেনদেন করেন। জমা থাকা ৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জব্দ করেছে দুদক ও বিএফআইইউ।
কে এই জাহাঙ্গীর: মো. জাহাঙ্গীর আলম, মাতারবাড়ী আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফ্রেন্ড পাওয়ার প্রজেক্টের (আরএইচডি) প্রকল্প পরিচালক। তার বাবার নাম ছিদ্দিক মিয়া। থাকেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বি ব্লকের একটি বাসায়। তিনি ফেনী সদর উপজেলার ফতেহপুর জাহানপুর গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। কর্মজীবনে তিনি ঠাকুরগাঁও, গোপালগঞ্জ ও রাজশাহী সড়ক বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের সড়ক উন্নয়ন অংশের পিডি।
গত বছরের ২৪ অক্টোবর জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী নুসরাত জাহানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার ভারপ্রাপ্ত মহানগর দায়রা জজ ইব্রাহিম মিয়া ওই আদেশ দেন।
দুদক বলছে, জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংসহ নিজের ও নির্ভরশীলদের নামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি এবং তার স্ত্রী দেশ ছেড়ে বিদেশে পালানোর এবং স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ হস্তান্তর করার চেষ্টায় আছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। সে কারণে তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
দুদকের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম কালবেলাকে বলেন, এটা তো অনেক পুরোনো অভিযোগ, আমি তো বিষয়টি ভুলেই গেছি। ব্যাংক হিসাবে ১০ টাকা কয়েকবার লেনদেন হলেও অনেক বড় অঙ্ক দেখায়। দুদক কীসের ভিত্তিতে প্রতিবেদন করেছে আমার জানা নেই।
মন্তব্য করুন