বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা এবং অভ্যন্তরীণ নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ৬ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা সফর শেষে সংস্থাটির প্রতিনিধিদল এ তথ্য জানায়। একই সঙ্গে বিনিময় হার,
কর-জিডিপি রেশিও নিয়ে আপত্তি থাকলেও বাংলাদেশ সঠিক পথে আছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক এই দাতা সংস্থা।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানানো হয়। ব্রিফিংয়ে আইএমএফের গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান (মিশন প্রধান) ক্রিস পাপাজর্জিওসহ অন্য ৯ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
আইএমএফের সঙ্গে এ দফার পর্যালোচনা বৈঠক শেষে সমঝোতা হয়নি বাংলাদেশের। ফলে চলমান ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচি থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ পাওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত জানায়নি আইএমএফ প্রতিনিধিদল। আইএমএফ বলেছে, এ বিষয়ে আলোচনা আরও চলবে এবং সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে দুই কিস্তির অর্থ পাওয়া যেতে পারে আগামী জুনের শেষ দিকে।
মিশন প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠেয় আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হবে। এ বৈঠক হবে ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল।
বাংলাদেশের আইএমএফ মিশন চিফ ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, ‘বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস ঠিক রাখতে আর্থিক খাতের সামঞ্জস্য আনা দরকার। যদি ডলারের বিনিময় হার আরও নমনীয় করা হয়, তাহলে দেশের পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক থাকবে এবং বাইরের যে কোনো বড় ধাক্কা সামাল দেওয়ার শক্তি অর্থনীতির মধ্যে তৈরি হবে।’ এ সময় ঋণের শর্ত হিসেবে বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতিতে আইএমএফ সন্তুষ্ট নয় বলেও জানানো হয়।
আইএমএফের প্রতিনিধিদল বলছে, সংস্থাটি সব সময় সব দেশকেই বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেয়। একই পরামর্শ বাংলাদেশের জন্যও। তবে এখনই বাজারভিত্তিক করতে হবে বাংলাদেশকে এমন চাপ দেবে না সংস্থাটি। যদিও এখনই বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার সেরা সময় বলে মনে করছেন মিশন প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও।
তিনি বলেন, গত দুই বছর যাবৎ বাংলাদেশের রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছিল। কিন্তু বর্তমানে তা অনেকটাই স্থিতিশীল। একই সঙ্গে ডলারের অফিশিয়াল দর ও খোলা বাজারের দর প্রায় কাছাকাছি। এজন্য এখনই বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার সেরা সময়।
রাজস্ব আদায় বা কর জিডিপি রেশিও সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কর জিডিপি রেশিও অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক কম। এটি বাড়ানোর বিকল্প নেই। তবে বাংলাদেশ কর জিডিপি রেশিও বৃদ্ধিতে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব বোর্ড মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে, যাকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। তবে করনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য থাকা উচিত। এ ছাড়া করছাড় কমাতে হবে, করনীতিকে সহজ করতে হবে এবং রাজস্ব বৃদ্ধির টেকসই পথ খুঁজে বের করতে হবে।
পাপাজর্জিও মনে করেন, বাংলাদেশের রিজার্ভের পাশাপাশি বিনিময় হারও স্থিতিশীল। রিজার্ভের পরিমাণ এমনকি তাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আরও নমনীয় হলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বাড়বে। ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে আইনগত সংস্কার ও কার্যকর সম্পদ মান যাচাই এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সুশাসন জোরদারের প্রতিও গুরুত্বারোপ করে আইএমএফ।
সংস্থাটি বলেছে, অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার জোরালো অগ্রগতি দরকার।
সফর শেষে এক বিবৃতিতে মিশন প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ। এই পতনের কারণ হিসেবে গণআন্দোলনজনিত অস্থিরতা, কঠোর নীতিমালা এবং বিনিয়োগে অনিশ্চয়তাকে দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২৪ সালের জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি এক দশকে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছালেও, ২০১৫ সালের মার্চে তা কমে ৯ দশমিক ৪ শতাংশে নেমেছে। যদিও এই হার এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫-৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। কর নীতি ও প্রশাসন পৃথক করা এবং কর অব্যাহতি কমিয়ে কর পরিপালন বাড়ানোর কথা বলেছে প্রতিনিধিদলটি।
আইএমএফ বলছে, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আন্তর্জাতিক মানসম্মত আইনি সংস্কার ও ব্যাংক পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া জোরদার করা জরুরি। ছোট আমানতকারীদের সুরক্ষা, ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি, অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর), স্বচ্ছতা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এ ছাড়া আর্থিক খাতের কাঠামোগত সংস্কারের গতি অব্যাহত রাখার তাগিদ দিয়েছে আইএমএফ। যাতে তৈরি পোশাক খাতের বাইরে অন্যান্য রপ্তানি খাতও বিকশিত হয়। একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেয় সংস্থাটি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে ২০২২ সালে আইএমএফের দ্বারস্থ হয় তৎকালীন সরকার। সে সময় নানা শর্ত জুড়ে দিয়ে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন দেয় সংস্থাটি। পরে ৩ কিস্তিতে ছাড় হয় ২৩১ কোটি ডলার।
অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ঘুরে যায় আইএমএফ মিশন। সে সময় ডলারের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নির্ধারণ না করা, ৬৩ হাজার কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে না পারা; আর ভর্তুকি কমানোর প্রশ্নে অসন্তোষ প্রকাশ করে মিশন। শঙ্কা তৈরি হয় ঋণের বাকি অর্থ ছাড় নিয়ে। এবারও ১২ দিনের সফর শেষ হলো কোনো সমঝোতা চুক্তি ছাড়াই। এর আগে প্রতিবার মিশন শেষে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই হলেও এবার তা হয়নি। তবে আলোচনার দরজা খোলা আছে বলে জানিয়েছেন মিশনের প্রধান।
মন্তব্য করুন