দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় ২৮ বছর ধানমন্ডি এক নম্বর সড়কের বাড়িটিতে ছিলেন কবি রফিক আজাদ। বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদ এই বাড়িতে বসেই লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। দেশি-বিদেশি কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে গল্পে মশগুল থাকতেন এই বাড়িতেই। অসংখ্য বই লিখেছেন ও পড়েছেন ধানমন্ডি এক নম্বর সড়কের এই বাড়িতে বসে। ২০১৬ সালের ১২ মার্চ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই বাড়িতেই ছিল কবির বসবাস। মৃত্যুর পর কবির স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বাড়িটিতে ছিলেন তার স্ত্রী শিক্ষাবিদ দিলারা হাফিজ।
গতকাল বুধবার সকালে একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি রফিক আজাদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটির একাংশ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। চার ইউনিটের একতলা বাড়িটির একটি ইউনিটে থাকতেন কবি রফিক আজাদের পরিবার। বাকি তিনটি ইউনিট বরাদ্দ ছিল অন্যদের নামে। বাড়িটির পূর্বপাশের দুটি ইউনিট ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও প্রথম দিন রফিক আজাদ স্মৃতিবিজড়িত ইউনিটটি অক্ষত আছে। তবে সব গুঁড়িয়ে ফেলার ভয়ে কবির বই, ব্যবহার করা জিনিসপত্র পাশের একটি বাড়িতে স্তূপ করে রাখা হয়েছে।
নেটিজেনদের সমালোচনার মুখে দুটি অংশ ভাঙা না হলেও যে কোনো সময় ভেঙে ফেলা হবে বলে জানিয়েছেন কবির স্ত্রী দিলারা হাফিজ। তিনি বলেন, বুধবার যেভাবে বাকি দুই ইউনিট ভাঙা হয়েছে, জানি না আমাদের অংশটা কবে ভেঙে ফেলবে। আমি তো কবির স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি। সন্তানরা বিদেশে থাকে। আমরা অনেক বছর ধরে কবির স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি রক্ষার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কিন্তু কোনো সদুত্তর পাচ্ছি না। এই জায়গায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছি।
তিনি জানান, ১৯৮৮ সালে শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষক হিসেবে বাড়ির একটি ইউনিট বরাদ্দ পেয়েছিলেন দিলারা হাফিজ। তিনি সরকারি বাঙলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ এবং সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর অবসর নেন।
দিলারা হাফিজ কালবেলাকে বলেন, কবির মৃত্যুর পর তার স্মৃতি রক্ষার জন্য এই বাড়িটি পেতে সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। বিভিন্ন মহলে ঘুরেও এই আবেদনের সাড়া মেলেনি। উল্টো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে একাংশ। কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই এ কাজটি করা হয়েছে।
তিনি জানান, বুধবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাড়িটি ভাঙার কাজ শুরু করে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের প্রকৌশলী হারিজুর রহমান, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রট তৈমুর রহমান আশিকের নেতৃত্বে ৩০ থেকে ৪০ জনের একটি দল বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু করে। সে সময় পুলিশ ধানমন্ডির ১ নম্বরের সড়কটি বন্ধ করে দেয়। বাড়ির গ্যাস লাইন আপাতত বন্ধ আছে। সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুতের লাইন আসে।
দেশের অন্যতম প্রধান কবি এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কবি রফিক আজাদের সার্বিক অবদান মূল্যায়ন করে তার স্মৃতি সংরক্ষণ ও ধারণের জন্য বাড়িটির অংশবিশেষের স্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন দিলারা হাফিজ।
১৯৮৮ সালে একতলা এ বাড়িটি রফিক আজাদের স্ত্রী কবি দিলারা হাফিজের নামে সাময়িকভাবে বরাদ্দ দেয় ‘এস্টেট অফিস’। দিলারা হাফিজ তখন ইডেন কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
সে সময় সহকারী পরিচালক এম বেগমের স্বাক্ষর করা এ বরাদ্দনামায় উল্লেখ করা হয়, এই বরাদ্দের দ্বারা বাসার ওপর কোনো অধিকার বর্তাবে না, তবে পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে বসবাস করতে পারবেন।
দিলারা হাফিজ বলেন, দীর্ঘদিন পর বাড়িটি নিজের বলে দাবি করেন সৈয়দ নেহাল আহাদ নামে এক ব্যক্তি। ২০১২ সালে নিজের মালিকানার পক্ষে আদালতের রায় পান তিনি। এ নিয়ে সৈয়দ নেহাল, হাউজিং অ্যান্ড পাবলিক ওয়ার্কস এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে বিবাদী করে মামলা করেন দিলারা হাফিজ। এর ফলে আদালত বাড়িটির ওপর স্থিতাবস্থা দেন। পরের বছর এই স্থিতাবস্থা স্থায়ী করেন আদালত।
পরে মামলাটি ঢাকার সপ্তম সহকারী জজ আদালতে স্থানান্তরিত হয়। আগামী ২৫ মে এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের কথা রয়েছে। এসব তথ্য উল্লেখ করে গত মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, একই মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পৃথক চিঠি দেন দিলারা হাফিজ। এর মধ্যেই বুধবার সকালে বাড়িটি উচ্ছেদে অভিযান চালানো হয়।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ম্যাজিস্ট্রেট তায়েব-উর-রহমান আশিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘অভিযানে কবি রফিক আজাদের বাড়িটি ভাঙা হয়নি। সেখানে চারটি একতলা ভবন রয়েছে, যার সবগুলো ভাড়াটিয়াদের দখলে। এর মধ্যে কবি রফিক আজাদের বাসভবনসহ দুটি ভবনের বিষয়ে হাইকোর্টের স্থিতাবস্থার আদেশ আছে। আমরা রফিক আজাদের বাড়ির পেছনের দুটি ভবন ভেঙে ফেলেছি।’
তিনি বলেন, কবি রফিক আজাদের বাসভবনের কোনো অংশ ভাঙা হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, তার বাড়ির সীমানা প্রাচীর পুনর্নির্মাণ করা হবে।
মন্তব্য করুন