দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি মৃত নবজাতক জন্ম নিচ্ছে। সংখ্যাটি বছরে ৬৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এর পাশাপাশি প্রতি বছর এক লাখের বেশি নবজাতক জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যায়।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃ ও নবজাতক মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিশ্রুতি। তবে সময় ফুরিয়ে আসছে, এখন হাতে রয়েছে মাত্র চার থেকে পাঁচ বছর। এই সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
নবজাতক মৃত্যুর উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান ও কারণ: ইউনিসেফ এবং ইউএন ইন্টার-এজেন্সি গ্রুপ ফর চাইল্ড মর্টালিটি এস্টিমেশন (UN IGME) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে পাঁচ বছর বয়স না পেরোনো এক লাখের বেশি শিশু মারা গেছে, এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ মারা গেছে জন্মের প্রথম ২৮ দিনের মধ্যেই, প্রতি ৪১টি জন্মে একটি করে মৃত সন্তান প্রসব হচ্ছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।
এই উচ্চ মৃত্যুহারের কারণ হিসেবে উঠে এসেছে: অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রসব (প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু ঘরে জন্ম নিচ্ছে), অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে সন্তান জন্মদান, উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবার অভাব, বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ে ২৪ ঘণ্টার জরুরি সেবা না থাকা, সংক্রমণ, অপরিণত জন্ম ও জন্মকালীন শ্বাসরুদ্ধতার মতো প্রতিরোধযোগ্য জটিলতা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) হিসাবে, প্রতি বছর বিশ্বের ৩ লাখ প্রসূতি মৃত্যুবরণ করেন। অন্তত ২০ লাখ নবজাতক জন্মের প্রথম মাসে মারা যায়, আরও প্রায় ২০ লাখ নবজাতক মৃত অবস্থায় জন্ম নেয়, অর্থাৎ প্রতি ৭ সেকেন্ডে একটি প্রতিরোধযোগ্য শিশুমৃত্যু ঘটে বিশ্বজুড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে নতুন প্রত্যয়: আজ সোমবার, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে একযোগে বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘হেলদি বিগিনিংস, হোপফুল ফিউচারস’—‘জন্ম হোক সুরক্ষিত, ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত।’ এ উপলক্ষে গতকাল এক বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। নবজাতক ও প্রসূতির মৃত্যুহার কমানো এসডিজি অর্জনের মূল চ্যালেঞ্জ।’ তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নারী ও শিশুদের সুরক্ষা রয়েছে।
প্রতিরোধের উপায়: মাতুয়াইল শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (ICMH)-এর পরিচালক ডা. মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘একবারে শতভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে প্রতিটি প্রসূতির অন্তত চারটি প্রাতিষ্ঠানিক চেকআপ নিশ্চিত করতে হবে। গর্ভাবস্থায় কাউন্সেলিং, সেফ ডেলিভারির কনসেপ্ট, প্রশিক্ষিত ধাত্রী এবং নবজাতক বিশেষজ্ঞ উপস্থিত থাকলে বাড়িতেও নিরাপদ প্রসব সম্ভব।’
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মীর সাজেদুর রহমান বলেন, ‘মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমাতে বাল্যবিবাহ বন্ধ, প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি বাড়ানো এবং গৃহজ প্রসব রোধ জরুরি। আমাদের দেশের কর্মীরা ইতিবাচকভাবে কাজ করছে।’
তিনি আরও জানান, প্রায় ৩ হাজার ৭০০ ইউনিয়নে সাব-সেন্টারে জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, শূন্যপদে দ্রুত নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে, ঈদের ছুটিতেও নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেওয়া হয়েছে।
নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য এখনই পদক্ষেপ জরুরি: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশ যদি বছর অন্তত ২৮ হাজার অতিরিক্ত নবজাতকের জীবন রক্ষা করতে পারে, তাহলেই এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে। তবে সময় খুবই অল্প। এখনই সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ, দক্ষ জনবল নিয়োগ এবং স্বাস্থ্য অবকাঠামো জোরদারের মাধ্যমে সংকট মোকাবিলা না করা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।
মন্তব্য করুন