বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সংস্কারের প্রশংসা করলেও কর-জিডিপি রেশিও কম থাকা, সুদের হার বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পাশাপাশি সংস্থাটির দেওয়া শর্তগুলো প্রতিপালন ও মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের অগ্রগতি এবং ব্যাংকের বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ সম্পর্কেও জানতে চেয়েছে বাংলাদেশ সফরে থাকা আইএমএফের প্রতিনিধিদল। গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, ডেপুটি গভর্নর ও অর্ধডজন নির্বাহী পরিচালকের সঙ্গে বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা করেছে আইএফএফের প্রতিনিধিদল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আইএমএফের দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে কর-জিডিপি রেশিও এখনো ঠিক করতে পারেনি বাংলাদেশ, যা নিয়ে সংস্থাটি আপত্তি জানিয়েছে। সুদের হার বাড়ানোরও বিরোধিতা করেছে সংস্থাটি। অবশ্য এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের আগ পর্যন্ত সুদের হার কমানোর সুযোগ নেই। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে সংস্থাটি একে বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সংস্কারে যেসব পদক্ষেপ এরই মধ্যে নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশংসা করেছে আইএমএফ। একই সঙ্গে সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছে আইএমএফ। এ ছাড়া মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ সম্পর্কেও জানতে চেয়েছে সংস্থাটি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কালবেলাকে বলেন, ‘আইএমএফ আমাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলোর প্রশংসা করেছে। আমরা দ্রুতই আর্থিক খাতের সংস্কার বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। এ ছাড়া বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচক সম্পর্কেও তারা আলোচনা করেছে। সংস্থাটির সঙ্গে সর্বশেষ মিটিংয়ের পরই বিস্তারিত জানানো হবে।’
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের পর থেকে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকটি সার্কুলার দিয়েছে। এসব সার্কুলার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, সে বিষয়েও জানতে চেয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ম্যাক্রো ইকোনমির সংযোগ তৈরিতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়েও জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
এদিকে আইএমএফের ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ‘রাজস্ব সংগ্রহ করা, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াসহ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ প্রয়াস চলমান রয়েছে। আমাদের যা যা করার, তা করেছি, এখনো করছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা আমাদের গুড ইনটেনশন (ইতিবাচক মানসিকতা) দেখিয়েছি। এখন আইএমএফ ঋণের কিস্তি (টাকা) দিক বা না দিক এসব বিষয়ে তাদের। এখন আইএমএফের মনোভাব দেখানোর পালা। আমরা আশাবাদী।’
একই দিন আইএমএফের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের পর অর্থ উপদেষ্টা জানান, আইএমএফের রাজস্ব সংগ্রহের শর্তের বিষয়টি সরকার গুরুত্ব সহকারে দেখছে। এ প্রসঙ্গে আইএমএফকে জানানো হয়েছে যে, বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ জিরো রিটার্ন দেয়। বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও সাড়ে ৭ শতাংশ, যা নেপালে ১২-১৩ শতাংশ ও ভারতে ১৭-১৮ শতাংশ।
তিনি বলেন, ‘আমরা এসব বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ ও অগ্রগতি তাদের অবহিত করেছি। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ নিয়ে তারা উদ্বেগ জানিয়েছেন। আমরা তাদের সবকিছু জানিয়েছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল ও সঠিক পথে রয়েছে বলে আইএমএফ মনে করে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, বিনিময় হার স্থিতিশীল করা ও বাজেট ঘাটতি কমানোর বিষয়ে তারা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
ভ্যাট সিঙ্গেল রেটে নামিয়ে আনার বিষয়ে আপনাদের অবস্থান কী—জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ভ্যাটের হার সিঙ্গেল রেটে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছি। তবে ভ্যাট একবারে সিঙ্গেল রেটে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়।’
আইএমএফের ঋণের কিস্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দুই কিস্তির অর্থ একবারে দেবে। ওরা এখন রিভিউ করবে—আমরা ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও কীভাবে বাড়াব, ট্যাক্স কালেকশন কীভাবে করব। আইএমএফের উদ্বেগের জায়গা হলো রাজস্ব সংগ্রহ। আমাদের বাজেট সাইজ কত হবে, ঘাটতি কত হবে—এগুলো নিয়ে আপাতত কথা হয়েছে। আমার সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয়নি, এনবিআরের সঙ্গে কথা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কথা হবে লোন রেজ্যুলেশন নিয়ে। তারপর আপনারা কয়দিন পরে সব জানতে পারবেন।’
মন্তব্য করুন