ঈদ আসলে নেতাকর্মীদের বহর নিয়ে ঈদগাহে সালাত আদায় করা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎসহ গণভবনে ছিল মন্ত্রী-এমপিদের রাজকীয় মিলনমেলা। খাবারের তালিকায়ও থাকত রাজকীয় নানা পদ। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আসন্ন প্রথম ঈদে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপিসহ হেভিওয়েট নেতারা কেউ কারাগারে, কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কারাগারে থাকা ভিআইপি আসামি তথা আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, নেতাকর্মীদের ঈদ কেমন কাটবে তা জানতে চায় কালবেলা।
কারা অধিদপ্তর সূত্র কালবেলাকে জানিয়েছে, এসব ভিআইপি আসামির কারাগারে ঈদ কাটবে ভিআইপি ভাবেই। পরিবারে স্বজনদের সঙ্গে ঈদের দিন দেখা করার সুযোগ মিলবে। আসামিরা কারাগারে বসেই পাবেন স্বজনদের পাঠানো ঘরে বানানো খাবার। নিরাপত্তার জন্য ভিআইপি আসামিদের ফোনে কথা বলার সুযোগ বন্ধ থাকলেও ঈদ উপলক্ষে দেওয়া হবে ফোনে কথা বলার সুযোগও। শুধু তাই নয়, ঈদের দিন এসব ভিআইপি কারাবন্দির খাবারের তালিকাও কম রাজকীয় থাকবে না। পায়েস, পোলাও, গরুর মাংস, ডিমের কোর্মা, মুরগির রোস্ট, মাছসহ থাকবে আরও নানা পদের খাবার। খাবার শেষে আথিতেয়তার মতো থাকবে মিষ্টি, পান-সুপারিও।
ঈদে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎসহ মিলবে খাবার: কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম) জান্নাত-উল ফরহাদ কালবেলাকে জানান, সব বন্দি সাধারণ নিয়মে ১৫ দিনে একবার স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারে। তবে এর বাইরেও ঈদ উপলক্ষে ভিআইপিসহ সব আসামি একবার স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন। ঈদের দিন ও ঈদের পরের দুদিনে এই একবার দেখা করার সুযোগ পাবেন আসামিরা। এ ছাড়া এই তিন দিনে যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে একবার কারাগারের বাইরে থেকে স্বজনদের দেওয়া খাবার পাবেন ভিআইপিসহ সব আসামি। খাবার নিরাপদ কি না, তা যাচাইয়ের সুযোগ থাকবে।
ঈদের নামাজ কে কোন কারাগারে: কারা অধিদপ্তর ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মাধ্যমে জানা গেছে, কাশিমপুর কারাগারে আছেন সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, সাবেক সংসদ সদস্য হাজি সেলিম, বিএম ফজলে করিম চৌধুরী, এম এ মালেক, আব্দুর রহমান বদি, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক এমপি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও সাবেক এমপি আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি আহমদ হোসেন, সাবেক এমপি ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতসহ সাংবাদিক মোজ্জাম্মেল হক বাবু, শ্যামল দত্ত, শাকিল আহমেদ ও দেশ টিভির এমডি আরিফ হোসেনসহ অনেকে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি রয়েছেন। এ ছাড়া কাশিমপুর কারাগারের নারীদের ভবনে সাবেক শিক্ষা ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক এমপি ও হুইপ মাহবুব আরা বেগম গিনি, সাবেক এমপি মাসুদা সিদ্দীক রোজী, সাংবাদিক ফারজানা রুপা রয়েছেন।
এ ছাড়া বর্তমানে ঢাকার কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোটের মুখপাত্র আমির হোসেন আমু, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাবেক ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক খাদ্য উপমন্ত্রী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, সাবেক বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, সাবেক ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক এমপি সাদেক খান, পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামালসহ অনেকে।
কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম) জান্নাত-উল ফরহাদ বলেন, নিরাপত্তার জন্য ডিভিশনপ্রাপ্ত ভিআইপি বন্দিদের আলাদা সেলে রাখা হয়। ঈদের দিন প্রতিটি কারাগারে এসব ভিআইপি বন্দিকে একসঙ্গে নামাজের ব্যবস্থা থাকবে। তবে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে নয়। কারাগারে খোলা মাঠে ঈদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা থাকবে বলে জানান তিনি। তবে নারীদের ঈদের নামাজের কোনো ব্যবস্থার নির্দেশনা এখনো পর্যন্ত নেই বলে জানান তিনি।
মা বোন থাকলেও দেখা হবে না পলকের স্ত্রীর: আইনজীবীরা কালবেলাকে জানিয়েছেন, কাশিমপুরে জঙ্গি ও দুর্ধর্ষ আসামিদের হাই সিকিউরিটি ভবনে রাখা হয়েছে সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে। ঈদের দিন পলকের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন তার মা, ভাই ও তিন বোন। পলকের পছন্দের খাবার রান্না করে নিয়ে যাবেন তারা। তবে দুদকের মামলা থাকা আগেই পলাতক থাকা স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকার সঙ্গে ঈদের বিশেষ দিনে দেখা হবে না পলকের। স্ত্রীর সঙ্গে দেখা না হওয়ায় পলকের আফসোসটাই বেশি। এর আগে পলক আদালতে এসে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সবাইক ঈদের শুভেচ্ছা ‘ঈদ মোবারক’ জানান।
দীপু মণির সাক্ষাতের অপেক্ষায় স্বামীসহ মেয়ে: এদিকে দীপু মনির আইনজীবী গাজী ফয়সাল ইসলাম কালবেলাকে জানান, ঈদের দিন ডা. দীপু মনির সঙ্গে তার একমাত্র মেয়ে তানি দীপাভলী নাওয়াজ ও হুইল চেয়ারে থাকা স্বামী তৌফিক নাওয়াজ দেখা করবেন। এর আগে সাক্ষাতের দিন থাকলেও দেখা করতে পারেননি দীপু মনির স্বামী।
এদিকে বিভিন্ন আইনজীবীদের থেকে জানা গেছে, সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম তার মেয়ে ঢাকা উত্তেরর চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিনের সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ থাকায় দেখা করবেন না বুশরা। একসময় টাকার তোশকে ঘুমানো আর ঈদে নতুন টাকার বান্ডিল ছাড়া উপহার না নেওয়া আমির হোসেন আমু কারাগারের কাঠের চৌকিতে থেকে ঈদের দিনের প্রতীক্ষা করছেন স্বজনদের। সালমান এফ রহমানও তার স্বজনদের প্রত্যাশায় রয়েছেন। তবে তার কাছে বেক্সিমকো গ্রুপের খবরাখবর সম্পূর্ণ নিয়ে দেখা করার কথা বলেছেন স্বজন ও আইনজীবীদের।
এ ছাড়া কাশিমপুরে একই কারাগারে থাকলেও নারী ও পুরুষের ভবন আলাদা হওয়ায় স্বামী-স্ত্রীর ঈদে দেখা হওয়ার সুযোগ নেই সাংবাদিক দম্পতি ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের। তাদের সন্তান ও পরিবারের সদস্যরা পৃথকভাবে তাদের সঙ্গে দেখা করবেন। এদিকে আইনজীবীরা জানান, সব আসামির পরিবারই ঈদের দিন ও পরের দুদিনে দেখার করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সবাই চাইছেন ঈদের দিন দেখা করার। তবে সবার একদিনে দেখা করার সুযোগ দেওয়ার সক্ষমতা নেই বলে জানিয়েছে কারা অধিদপ্তর। ঈদের পর দুদিনে অনেককে সুযোগ দেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন