নুরুল ইসলাম মনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান। বরগুনা-২ আসন থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৮৮ ও ১৯৯১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং ২০০১ সালে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন। একই আসনে আগামী নির্বাচনেও বিএনপি থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, গণপরিষদ নির্বাচন, সংবিধান, বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কালবেলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রাজকুমার নন্দী
কালবেলা: আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও জুলাই গণহত্যার বিচারের বিষয়টি রাজনীতিতে আবারও আলোচনায়। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
নুরুল ইসলাম মনি: কতগুলো বিষয় পরিকল্পিত, আবার কতগুলো অপরিকল্পিত। এটা (আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ) পরিকল্পিত কি না জানি না। বিএনপি থেকে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, দল নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এই দেশের জনগণ। তারা ভোট দেওয়ার মাধ্যমে তাদের এই সিদ্ধান্ত নেবে। নির্বাচনী ইশতেহারে যদি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার কথা থাকে এবং জনগণ যদি ভোট দেয়, তাহলে তো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে। আমরা দল নিষিদ্ধ করার কে? জনগণ চাইলে আওয়ামী লীগ এ দেশে রাজনীতি করতে পারবে, না চাইলে পারবে না। শেখ হাসিনা জামায়াতে ইসলামীকে ব্যান্ড (নিষিদ্ধ) করেছিল। তার ফল কী হয়েছে? সেই জামায়াত তো এখন তাদের রাজনীতি করে, তারা মাঠে আছে। সুস্থ রাজনীতির জন্য বহু দল দরকার। এখন জনগণ কাকে বেছে নেবে, সেটা তাদের ব্যাপার।
শেখ হাসিনার আমলে বহু হত্যা হয়েছে। সেই গণহত্যার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। হঠাৎ করে লাফ দিয়ে এসে এক মাস আন্দোলন করে সফল হয়েছেন, বিষয়টা এমন নয়। একটা ক্ষেত্র, পরিবেশ তৈরি হওয়ার পর ছাত্ররা সেই পরিবেশটা কাজে লাগিয়েছেন। একটা কেটলিতে পানি রাখলে সেটি হঠাৎ করেই বাষ্পে পরিণত হয় না, সেজন্য যথেষ্ট সময় লাগে। নিচে আগুন দিয়ে জাল দিতে হয়, পানি উত্তপ্ত হওয়ার পর বুদবুদ (বাবল) হয়, তারপর বাবল থেকে বাষ্পে পরিণত হয়। যদি কেউ বলে, আমি কেটলিতে পানি দিলাম, আর সঙ্গে সঙ্গেই সেটা বাষ্প হয়ে উড়ে গেল, এটা তো সঠিক নয়। গণঅভ্যুত্থানের বিষয়টা হঠাৎ করে জুলাই মাসে শুরু হয়ে শেষ হয়ে যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে এর প্রেক্ষাপট তৈরি করতে হয়েছে। একটা গাছ লাগিয়ে তাতে ফল আসতে পাঁচ-সাত বছর সময় লাগে।
হাসিনা যে স্বৈরাচার, সেটা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে বিএনপি; মামলা-হামলা, গুম-খুন, অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়ে। এই কাজটা ১৭ বছর ধরে হয়েছে। কাজেই এই ১৭ বছরে যেসব গুম-
খুন হয়েছে, সেগুলোর যেমন বিচার হতে হবে; তেমনি জুলাই গণহত্যারও বিচার হতে হবে। সবটার বিচার হতে হবে, এই বিচার আমরা চাই। একই সঙ্গে পিলখানায় পরিকল্পিতভাবে যে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যা করা হয়েছে, সেটারও বিচার হতে হবে। শাপলা চত্বরে হেফাজতের যে হত্যা হয়েছে, তার বিচার হওয়া দরকার। নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে যারা টর্চার করেছে, তাদেরও বিচার হতে হবে। অপরাধ করে অপরাধী যদি পার পেয়ে যায়, তাহলে সমাজে অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। কাজেই অপরাধী পার পায়নি, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস হয়তো সেটা শুরু করতে পারবেন, শেষ করতে হবে কোনো একটা নির্বাচিত সরকারকে।
কালবেলা: সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার একটা চেষ্টা চলছে বলে সম্প্রতি বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
নুরুল ইসলাম মনি: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা। সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এই বিষয়টা অনেকে না বুঝে সেনাবাহিনী সম্পর্কে কথা বলেছে। অনেকের বয়স হয়নি, এটা বোঝার। এটার ইমপ্যাক্ট (প্রভাব) কী, তার ইমপ্লিকেশন (বাস্তবায়ন) কী, ফাইনালি এটা কোথায় গিয়ে গড়াতে পারে, সেটা অনেকের বোঝার বয়স হয়নি। এটা না বুঝেই তারা হয়তো কথা বলেছে। এই জায়গায় তাদের হাত দেওয়া ঠিক হয়নি।
কালবেলা: বিএনপি থেকে বলা হচ্ছে, সংস্কারের ইস্যুটি সামনে এনে জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করার পাঁয়তারা চলছে। কেন এমনটা বলা হচ্ছে? সংস্কার ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান কী?
নুরুল ইসলাম মনি: সংস্কার নিয়ে ইতোমধ্যে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো সংস্কার দৃশ্যমান নয়। সংগত কারণেই বলা যেতে পারে, সংস্কার নির্বাচনকে বিলম্বিত করার একটি ষড়যন্ত্র।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রদের একটা নতুন পার্টি গঠিত হয়েছে; তারা মাঠে এসেছে, রাজনীতি করতে চাচ্ছে। সেই শক্তিটা যাতে শক্তিশালী হয়, পরবর্তী নির্বাচনে ভালো করতে পারে, তার জন্য লম্বা সময় নিতে এই সংস্কার প্রক্রিয়া বলে দেশবাসী মনে করে।
গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রের একটি মৌলিক পরিবর্তন তথা একটি কল্যাণমূলক মানবিক রাষ্ট্রের জন্য বিএনপি গত ১৭ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। এ জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দুই বছর আগে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবনা দিয়েছেন। এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কেউ টানা দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এর চেয়ে বড় কোনো সংস্কার বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে আমি দেখিনি। এ ছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট (উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ) সংসদের কথাও বলা হয়েছে। রয়েছে প্রান্তিক মানুষের কথাও। অর্থাৎ দেশের প্রয়োজনে যেসব সংস্কার দরকার, তার প্রায় সবই ৩১ দফায় রয়েছে। এর পরও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, এটাই শেষ নয়, সময়ের প্রয়োজনে আরও নতুন বিষয় এখানে যুক্ত হতে পারে।
বিএনপি সংস্কার এবং গণতন্ত্র চায়। গণতন্ত্র নিজেই একটা সংস্কার। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনই হবে প্রধানতম সংস্কার। আমরা একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। সেখানে যারাই বিজয়ী হবে, তারাই সরকার গঠন করবে, এর চেয়ে বড় সংস্কার আর কী আছে। কিন্তু সংস্কারের নাম দিয়ে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। এখন আপনারা সংস্কার করলেন, পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকার এসে বলল, আমরা মানি না। তখন কী করবেন?
সরকারকে বলব, নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে যতটুকু সংস্কার দরকার, সেটা করুন। এখন প্রশ্ন হতে পারে, হাসিনা তো নিজের মতো করে একটা বাগান সাজিয়ে গেছে। তার আমলা বাহিনী সব আছে। তারাই তো নির্বাচন করবে। এ জন্য আগে সব জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হবে। এক্ষেত্রে বলব, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও তার নয় বছরের শাসনামলে পছন্দমতো লোক দিয়ে একটা বাগান সাজিয়েছিলেন। এরশাদের পতনের পরে সেই বাগানে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে
অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। সেটা তো তখন সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং হাসিনার রেখে যাওয়া এই বাগানে অন্তর্বর্তী সরকার যদি মনে করেন, তারা একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন, তাহলে সেটা সম্ভব। নির্বাচন বিলম্বিত করার কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচন বিলম্বিত হলে দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে এবং পতিত স্বৈরাচার আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
কালবেলা: সাম্প্রতিক সময়ে গণপরিষদ নির্বাচন এবং সংবিধান বাতিলের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এ নিয়ে আপনার অভিমত কী?
নুরুল ইসলাম মনি: গণপরিষদ নির্বাচনের বিষয়টা এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) বলছে। আমরা সংবিধান পুনর্লিখন করব, নাকি সংবিধান সংশোধন করব, সেটা বড় ব্যাপার। যদি পুনর্লিখন করি, তাহলে হয়তো গণপরিষদ নির্বাচন লাগতে পারে। গণপরিষদের সঙ্গে নতুন সংবিধানের সম্পর্ক। আমি মনে করি, সংবিধান নতুন করে লেখার প্রয়োজনীয়তা নেই। কারণ, দেশে একটি সংবিধান বিদ্যমান রয়েছে। এই সংবিধানের অধীনে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নিয়েছে। সে কারণে গণপরিষদের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে বিদ্যমান সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন প্রয়োজন। সংবিধানে কী কী সংশোধনী প্রয়োজন, সেটা নির্বাচিত সংসদে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে। কেউ যদি সংবিধান লঙ্ঘন করে নিজেকে স্বৈরাচার হিসেবে উপস্থাপিত করতে চায়, সেখানে সংবিধানে ভালো কথা লেখা থাকলেই কী আর না থাকলেই বা কী। সংবিধানে খুব ভালো কথা, ভালো জিনিস লেখার পরও একজন সেটা মানল না, আপনি কী করবেন? হিটলারও তো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে তিনি হলেন পৃথিবীর নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার। কাজেই সংবিধান লেখার চেয়ে যথাযথ প্র্যাকটিসের বিষয়টি হলো বড়। পৃথিবীর সব সংবিধানে ভালো কথা লেখা থাকে। খারাপ যেটুকু আছে, সেটুকু বাতিল করুন; ভালো কথা অন্তর্ভুক্ত করতে হলে, সেটা করুন। এজন্য সংবিধান পুনর্লিখনের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এটা হলো সময়ক্ষেপণ করার একটা কৌশল মাত্র।
কালবেলা: জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টিও রাজনীতিতে আলোচিত হচ্ছে। বিএনপি কেন আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না?
নুরুল ইসলাম মনি: একটি সরকারকে রিপ্লেস করবে আরেকটি সরকার এসে। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন দিয়ে তো সরকার হবে না, এর জন্য পার্লামেন্ট হতে হবে। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের যেসব লোক এখনো বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তাদের পুনর্বাসন করার একটি প্রক্রিয়া হবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। যারা পরিকল্পিতভাবে, কৌশলে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়, তারা মূলত পতিত সরকারের লোকজনকেই পুনর্বাসন করতে চায়। তা ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন একটি দেশের কোনো পলিসি পরিবর্তন করতে পারে না, সেটা করবে সরকার। বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কও স্থাপন করবে সরকার। সেজন্য আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগেই চাই, আর এটাই বাস্তবতা। যে জাতীয় নির্বাচন চায় না, সে হয়তো না বুঝে চায় না, অথবা তিনি একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। জাতীয় নির্বাচন হলে দেশে বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কেটে যাবে এবং মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হবে।
কালবেলা: বিএনপি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন চায়। সেক্ষেত্রে আপনাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি কেমন?
নুরুল ইসলাম মনি: আগামী এক মাস পরে নির্বাচন হলেও বিএনপি তিনশ আসনে নির্বাচন করার মতো সামর্থ্য ও প্রস্তুতি রাখে। আওয়ামী লীগ আমলে খুলনায় মেয়র নির্বাচনে প্রচুর ভোট পায় বিএনপির প্রার্থী। এটা দেখে শেখ হাসিনা তখন বলেছিলেন, এত ভোট বিএনপি কী করে পেল? অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, এত মামলা-হামলা, গুম-খুন, নির্যাতন-নিপীড়নের পরও বিএনপি এত ভোট কোথা থেকে পেল? আমরা বলব, বিএনপি গণমানুষের দল; মানুষের মধ্যে বিএনপি একটা আস্থা, বিশ্বাস ও আবেগের জায়গা। সেই আবেগটা রয়েছে দেশের মানুষের হৃদয়ে। সেটা কালকে আপনি ‘ফুঁ’ দিয়ে নিভিয়ে দেবেন, সেটা সম্ভব নয়।
নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পর্কে বলব, আগামী ১৫ দিন কিংবা এক মাস অথবা দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশে তিনশ আসনে নির্বাচন করার মতো সাংগঠনিক শক্তি রাখে বিএনপি। কারণ, বিএনপি এ দেশের সবচেয়ে বড় দল এবং মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য দল। বিএনপি শিক্ষিত, রুচিশীল, পরিশীলিত ও সৃষ্টিশীল মানুষের দল। গণমানুষ সন্ত্রাস, লুটপাট চায় না; তারা আইনের শাসন চায়। সে কারণে মানুষ বিএনপিকে পছন্দ করে। এই কারণে যে কোনো সময়, যে কোনো পরিস্থিতিতে বিএনপির পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব।
মন্তব্য করুন