রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুস সালাম (৫৩) গত বছরের অক্টোবর ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। ওই সময় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার কিডনি রোগ ধরা পড়ে। ডেঙ্গু থেকে সুস্থ হয়ে উঠলেও এখন সপ্তাহে অন্তত দুইবার কিডনি ডায়ালাইসিস করাতে হচ্ছে। প্রতিবার ডায়ালাইসেসর ব্যয় ৩ হাজার টাকার বেশি। ফলে প্রতি মাসে শুধু ডায়ালাইসিসেই খরচ হয় ৩০ হাজার টাকার বেশি। কিডনি সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস সমস্যার ওষুধ, চিকিৎসক বিল, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাতায়াতে ওই পরিবারের ব্যয়ের বোঝা ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। আইনি জটিলতার কারণে দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনও করতে পারছেন না। ফলে ডায়ালাইসিসও তার একমাত্র ভরসা। চিকিৎসার এই টাকার জোগান দিতে আবদুস সালামের পরিবারকে হিমশিম খেতে হয়।
মাদারীপুরের শিবচরের সালেহা বেগমের পরিবারের ভোগান্তি আরও বেশি। রাজধানীকেন্দ্রিক কিডনি ডায়ালাইসিস সেবার সিংহভাগ হওয়ায় প্রতি সপ্তাহে শিবচর থেকে ঢাকায় এসে তাদের ডায়ালাইসিস করাতে হয়। এতে চিকিৎসার সঙ্গে যাতায়াত ও অন্যান্য ব্যয়ে পরিবারটিকে আর্থিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। সালেহা বেগম গতকাল বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডি একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতে এসেছিলেন। সেখানে কথা হয় তার ছেলে তুমন হাসানের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, প্রতিনিয়ত কিডনি রোগী বাড়ছে। বাড়ছে ডায়ালাইসিস সেবার চাপ। শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, অথচ সেবার পরিধি শুধু শহরে। এতে ভোগান্তি ও নিয়মিত চিকিৎসাসেবা গ্রহণে বাধা তৈরি হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এই সেবা শহরের বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া না হলে একসময় রোগী ও তার পরিবারকে হাল ছেড়ে মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনতে হবে।
চিকিৎসকরা জানান, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের দীর্ঘদিন কিডনি চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া অনেকটা অসম্ভব। ফলে অনেকে কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভিটামাটি বেচে নিঃস্ব হচ্ছেন। মাসে মাসে বিপুল ব্যয়ের চাপ থেকে বাঁচতে অনেকে কিডনি প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চালান। সেখানেও রয়েছে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা। এমন পরিস্থিতিতে আজ ১৩ মার্চ সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও কিডনি দিবস পালন করা হবে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য— ‘আপনার কিডনি ঠিক আছে কি? তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করুন, কিডনির স্বাস্থ্য রক্ষা করুন।’
কিডনি দিবস উপলক্ষে রাজধানীর মগবাজার ইনসাফ বারাকাহ কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে মাসব্যাপী মূল্য ছাড়ে কিডনি রোগের চেকআপ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা, সেমিনারসহ নানা কর্মসূচিতে দিবসটি পালিত হবে।
তথ্যমতে, সারা দেশে সরকারি ৪৫টিসহ দেশে এখন প্রায় আড়াইশটি সেন্টারে কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা চালু রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ৩০ হাজারের মতো মানুষের সেবার সক্ষমতা রয়েছে। অথচ প্রায় ৮ লাখ মানুষের নিয়মিত ডায়ালাইসিস প্রয়োজন। অন্যদিকে প্রতি মাসে ৫ হাজার মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপনের চাহিদা থাকলেও সম্পন্ন হচ্ছে মাত্র ৩০০ এর কাছাকাছি। আইনি জটিলতায় অনেকটা বাধ্য হয়ে বহুগুণ খরচে দেশের বাইরে প্রতিস্থাপন করছেন অনেকেই। তবে যারা বিদেশ যেতে পারছেন না বা দেশেও প্রতিস্থাপনের খরচ জোগাতে পারছেন না, তারা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটির (ক্যাম্পস) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ বলেন, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, নেফ্রাইটিস, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, ব্যথানাশক ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার, জন্মগত ও বংশগত কিডনি রোগ, মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ ও পাথুরে রোগ কিডনি রোগের অন্যতম কারণ। সচেতন হলে কিডনি রোগ প্রতিরোধযোগ্য। তা ছাড়া যারা ঝুঁকিতে আছেন যেমন যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন বেশি, বংশে কিডনি রোগ আছে, যারা ধূমপায়ী, যারা তীব্র মাত্রার ব্যথার ওষুধ খেয়েছেন, যাদের পূর্বে কোনো কিডনি রোগের ঝুঁকি আছে, তাদের বছরে অন্তত দুইবার প্রস্রাব ও রক্তের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। কেননা প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ শনাক্ত করতে পারলে চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ডা. সামাদ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় কিডনি রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থূলতার মতো অসংক্রামক রোগের কারণে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ শুধু দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এই সংখ্যা ডায়াবেটিস রোগীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ এবং ক্যান্সার রোগীদের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ। মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিডনি রোগ ১৯৯০ সালে ছিল ১৯তম স্থানে, বর্তমানে দাঁড়িয়েছে সপ্তম স্থানে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালে দখল করে নেবে পঞ্চম স্থান।
‘আউট অব পকেট কস্ট অব কিডনি ডায়ালাইসিস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক বিআইডিএসের গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়ালাইসিসের পেছনে দেশের একজন কিডনি রোগীকে মাসে সর্বনিম্ন ৬ হাজার ৬৯০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ লাখ ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। গড় ব্যয় ৪৬ হাজার ৪২৬ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৩৫ দশমিক ২৮ শতাংশ ব্যয় হয় ডায়ালাইসিসে। এ ছাড়া কনসালটেশন ফি ২ দশমিক ৪১, ওষুধ কিনতে ২২ দশমিক ৮৭ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ১০ দশমিক ১ শতাংশ। আরও আছে শয্যা ভাড়া ২ দশমিক ৪৯, চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যয় ৪ দশমিক ৪ এবং অন্যান্য খাতে খরচ ১ দশমিক ৭০ শতাংশ। নন-মেডিকেল ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে যাতায়াতে ৮ দশমিক ৫৩, খাদ্যে ২ দশমিক ৭৪ এবং সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয় শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৯২ দশমিক ৮৭ শতাংশ পরিবারই ডায়ালাইসিস করাতে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়ে। সাড়ে ১৯ শতাংশ রোগী প্রয়োজনের চেয়ে কম ডায়ালাইসিস করান। ডায়ালাইসিস কম করানোর কারণ হিসেবে আর্থিক অসংগতির কথা উল্লেখ করেছেন ৯৫ শতাংশের বেশি। মানুষের পকেট থেকে যে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, এর মধ্যে শুধু ডায়ালাইসিস ফি দিতেই মাসে ব্যয় সর্বনিম্ন ৪৫৮ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৭৮ হাজার টাকা। এ ছাড়া ডায়ালাইসিসে যুক্ত আরও প্রায় ৬ ধরনের সরাসরি মেডিকেল চিকিৎসা-সংক্রান্ত ব্যয় ৪ হাজার ২৮০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ লাখ ২ হাজার ৮০০ টাকা। অন্যদিকে কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস করাতে ৬ ধরনের নন-মেডিকেল খরচ হয় শূন্য থেকে ৯২ হাজার ৬০০ টাকা।
ওয়েলথ ইনডেক্স অনুযায়ী, অসংক্রামক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মধ্যে কিডনি ডায়ালাইসিসে একজন রোগীর পকেট থেকে ব্যয় মোট আয়ের ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া মোট খাদ্যবহির্ভূত ব্যয়ের ৪০ শতাংশই যায় নিজের পকেট থেকে। এ ক্ষেত্রে অতিদরিদ্রদের পকেট থেকে খরচ হয় ৯২ দশমিক ৭১ শতাংশ, গরিবদের ৮৯ দশমিক ৪৭, মধ্য-আয়ের মানুষের ৯২ দশমিক ৫৫, ধনীদের ৮৪ দশমিক ৩৮ এবং অতিধনীদের ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
কিডনি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষের অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ কিডনির বিভিন্ন রোগ। এদের মধ্যে অন্যতম ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বা সিকেডি। বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ কিডনির বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস, নেফ্রোটিক সিনড্রোমসহ বেশ কিছু কারণে কিডনি বিকল হতে পারে। শুধু রক্তের সিরাম ক্রিয়েটিনিন এবং ইউরিন পরীক্ষা করেই কিডনি রোগের স্ক্রিনিং করা যায়। অর্থাৎ একজন মানুষের কিডনি রোগ আছে কি না, প্রাথমিকভাবে নির্ণয় করা যায়। কিডনি রোগের সঙ্গে হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস জটিলতা থাকে। ফলে সব জটিলতায় অসংখ্য মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে কিডনি সব রোগের আধুনিক চিকিৎসা বাংলাদেশে সহজলভ্য। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, রক্তে অতিরিক্ত চর্বি, বাড়তি ওজন, ধূমপানসহ বিভিন্ন রিস্ক ফ্যাক্টর নিয়ন্ত্রণ করে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
মন্তব্য করুন