মাহে রমজানে কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে সারা দেশে ইফতার মাহফিলের কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। রমজানে মাঠে অন্য কর্মসূচি না থাকায় ইফতার মাহফিলই কার্যত দলীয় কর্মসূচি। তাই ইফতারপূর্ব আলোচনায় বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা তুলে ধরা হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় গরিব-অসহায় মানুষের মধ্যে ইফতার ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। সামনে সামর্থ্য অনুযায়ী নিজ নিজ এলাকায় জাকাত-ফিতরাসহ সদকার অর্থ বিতরণ করবেন নেতারা। শিগগির ঈদ উপহারসামগ্রী নিয়ে সারা দেশে গুম-খুনের শিকার এবং গণঅভ্যুত্থানে দলের নিহত প্রায় ১৭০০ নেতাকর্মীর পরিবারের পাশে দাঁড়াবে বিএনপি। উদ্দেশ্য, নির্বাচন সামনে রেখে জনবান্ধব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করা। এ বিষয়ে দলের উচ্চ পর্যায় থেকেও বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে তৃণমূলে ইফতার আয়োজনের মধ্য দিয়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, কেন্দ্র থেকে তা কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। রোজার মাস ঘিরে নিকট অতীতে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বিএনপি নেতারা বলছেন, এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে—তৃণমূলে থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রতিটি ইফতারে সর্বস্তরের জনগণকে যেন সম্পৃক্ত করা হয়। কোথাও ব্যত্যয় দেখা গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে গেলে জানা গেছে।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি, যা রোজার মধ্যে মেনে চলতে বলা হয়েছে। গত সোমবার দলের পক্ষ থেকে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, দেশের মহানগর, জেলা ও উপজেলাসহ সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত পাঁচ দফা নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘এই রমজান মাসে দলের পক্ষ থেকে তৃণমূল স্তর থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বাহুল্য পরিত্যাগ করে সাদামাটাভাবে ইফতার ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা মহানগরসহ (উত্তর ও দক্ষিণ) সারা দেশে ওয়ার্ড পর্যায়ে মসজিদ কিংবা বাজার সংলগ্ন খোলা জায়গায় ইফতার ও দোয়া মাহফিলের উদ্যোগ নিতে হবে। ইফতার ও দোয়া মাহফিলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ব্যানারে শুধু ‘ইফতার ও দোয়া মাহফিল’ লেখা থাকবে। আগামী ২০ রমজানের মধ্যে ইফতার ও দোয়া মাহফিলের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দীর্ঘদিন পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে বিএনপির বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা থেকে নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে প্রস্তুত করতে তৃণমূল নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। একই সঙ্গে নেতাদের সতর্ক করে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনের মাঠ কঠিন হতে পারে। সেক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি নির্বাচনী প্রস্তুতি নেওয়ারও নির্দেশনা দেন। এ ছাড়া জনগণের পাশে থেকে জনগণকে পাশে রেখে তাদের মনজয়ের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এমন প্রেক্ষাপটে রমজানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে ইফতার ও দোয়া মাহফিল করার নির্দেশনা দিল বিএনপি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্দেশনা অনুযায়ী এবার রমজানে তৃণমূল অর্থাৎ একেবারে ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত ইফতার ও দোয়া মাহফিল করছে বিএনপি। এসব ইফতারে জনসম্পৃক্ততার বাড়ানোর মধ্য দিয়ে মূলত আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রাক-প্রস্তুতি সেরে নিতে চাইছে দলটি। এ কারণে আগামী নির্বাচনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী এবং অতীতে যারা নির্বাচন করেছেন, সবাই এখন নিজ নিজ এলাকায় বেশ সক্রিয়। প্রায় প্রতিদিনই তারা ইফতার মাহফিলে যোগ দিচ্ছেন। পহেলা রমজান থেকে শুরু হওয়া ইফতারের এই কর্মসূচি চলছে সারা দেশে। কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী ২০ রমজান পর্যন্ত এটা চলবে।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, এবারের রমজানে বিএনপির পক্ষ থেকে চারটি ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে প্রথম রোজায় আলেম-ওলামা ও এতিমদের নিয়ে ইফতার করেছে বিএনপি। আগামীকাল (আজ) গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনে কূটনীতিকদের সম্মানে ইফতার পার্টি হবে। এ ছাড়া আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনের লেডিস ক্লাবে রাজনীতিকদের সম্মানে এবং ১২ ফেব্রুয়ারি একই স্থানে পেশাজীবীদের সম্মানে ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম কালবেলাকে বলেন, ‘কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের আলোকে চট্টগ্রাম বিভাগে দলের প্রতিটি উপজেলা, জেলা-মহানগর ইফতার মাহফিলের প্রস্তুতি নিয়েছে। এটা একেবারে তৃণমূল অর্থাৎ ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত যাবে। সেখানে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে ইফতার ও দোয়া মাহফিল করা হচ্ছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইফতার মাহফিলপূর্ব সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বিএনপি ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা সর্বসাধারণের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। যদিও বেশ আগে থেকেই এটা আমরা মানুষের কাছে তুলে ধরছি।’
দলের খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ‘আমরা প্রতিবারই ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে থাকি। কিন্তু বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে ইফতার মাহফিলের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও আমাদের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে ফ্যাসিবাদের পতনের পর এবার দেশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা প্রতিটি উপজেলার ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যন্ত মুক্ত পরিবেশে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করছি। এখানে দলীয় নেতাকর্মীরা যেমন থাকছেন, তেমনি আমাদের আহ্বানে সাধারণ মানুষও অংশ নিচ্ছেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জনগণ যদি আমাদের ওপর আস্থা রাখে এবং আগামী নির্বাচনে আমরা যদি বিজয়ী হই, তাহলে আগামীতে আমরা কেমন বাংলাদেশ গড়তে চাই, জনগণের জন্য আমরা কী করতে চাই—সেটা ইফতারপূর্ব আলোচনায় উঠে আসছে। সেক্ষেত্রে আমাদের ৩১ দফার কথাও ফলাও করে বলা হচ্ছে।’
তৃতীয় রোজায় রাজধানীতে সাধারণ মানুষকে নিয়ে একসঙ্গে ইফতার করেছেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক। এটা অব্যাহত রাখবেন জানিয়ে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এবার আমাদের ইফতার মাহফিলগুলো হচ্ছে সরাসরি সাধারণ মানুষের জন্য। আমরা মহানগর উত্তরের প্রতিটি ইউনিটের বাজার, পাড়া-মহল্লা, বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ইফতার বিতরণ, ইফতার মাহফিলের কর্মসূচি পালন করছি। সাধারণ মানুষকে নিয়ে আমরা এই ইফতার করছি। বিএনপি গণমানুষের দল, সাধারণ মানুষের জন্য আমাদের সব কার্যক্রম।’
এদিকে গত কয়েক রমজানের মতো এবারও ফ্যাসিবাদবিরোধী গত ১৬-১৭ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামে দলের গুম-খুনের শিকার হওয়া ১ হাজার ১৫০টি পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছে বিএনপি। এর সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েয়ে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে দল ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নিহত ৫০০ নেতাকর্মীর পরিবার। ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ সংগঠনের ব্যানারে সব মিলিয়ে এবার সারা দেশে প্রায় এক হাজার সাতশ অসহায় পরিবারের মধ্যে ঈদ উপহারসামগ্রী পাঠাবে বিএনপি।
‘আমরা বিএনপি পরিবার’-এর আহ্বায়ক সিনিয়র সাংবাদিক আতিকুর রহমান রুমন এ তথ্য জানিয়ে কালবেলাকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে ঈদ উপহারসামগ্রী পাঠানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। শিগগির এসব অসহায় পরিবারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে ঈদ উপহারসামগ্রী পৌঁছানোর কার্যক্রম শুরু হবে।’ এদিকে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির বিরুদ্ধে নানামুখী চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে অভিযোগ দলটির। বিএনপি মনে করছে, চাঁদাবাজি-দখলবাজির কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটাকে সামনে আনা হচ্ছে না। একটি দল, একটি মহল বিএনপির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বড় ধরনের ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে, যাতে ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো যাতে সুবিধা করতে পারে; সেজন্য বিএনপির বিরুদ্ধে এই ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে তারা। বিএনপি নেতারা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে যতটা না ঘটছে, তার চেয়ে প্রচার-প্রোপাগান্ডা বেশি। তাই বিএনপি নেতাকর্মীদেরও এই ক্যাম্পেইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বলা হয়েছে।
মন্তব্য করুন