চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা জানুয়ারির শুরুতে আর মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা ১৫ জানুয়ারির মধ্যে বিনামূল্যের পাঠ্যবই পেয়ে যাবে—বছরের শুরুতে এমনটিই বলেছিলেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান; কিন্তু তিনি সেই কথা রাখতে পারেননি। এরপর বারবার সময় উল্লেখ করে শুধু আশ্বাসই দিয়ে গেছেন, বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কর্মপরিকল্পনার ঘাটতি ও বিভিন্ন সংকটের কারণে ফেব্রুয়ারি পার করে মার্চ চলে এলেও এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ কোটি বই যায়নি শিক্ষার্থীদের হাতে। এরই মধ্যে রোজা শুরু হয়ে গেছে। ঈদুল ফিতর ঘিরে স্কুলগুলোতেও বেজেছে ছুটির ঘণ্টা। ফলে শিক্ষার্থীদের মনে ঈদের আনন্দ চলে এলেও বই পাওয়া নিয়ে তাদের দুঃখ ঘুচল না।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই বাতিল, টেন্ডার বাতিলসহ নানা পরিস্থিতিতে কিছুটা বিলম্বে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু হয়। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুততার সঙ্গে পাঠ্যবই ছাপার কাজ শেষ করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এনসিটিবির গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসানকে বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আনা হয়। পরে তার সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ দুই মাস বাড়ানোও হয়। তবে তাতেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাঠ্যবই ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
এনসিটিবির তথ্য অনুযায়ী, এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৪ কোটি ৩৪ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটির বেশি বই। এর মধ্যে প্রাথমিকের বই ৯ কোটি ১৯ লাখ ও মাধ্যমিকের ৩০ কোটি ৯৬ লাখ। এখনো প্রাথমিক পর্যায়ের ৭ লাখ বই ছাপা বাকি, আর সরবরাহ বাকি ১৮ লাখ বই। ছাপা ও সরবরাহে সবচেয়ে পিছিয়ে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই। অন্যদিকে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৩ কোটি বই ছাপা বাকি, আর সরবরাহ বাকি সাড়ে ৬ কোটি বই। মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাপা ও সরবরাহে পিছিয়ে আছে অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই।
এনসিটিবির উৎপাদন শাখা থেকে জানা গেছে, গত রোববার পর্যন্ত প্রাথমিকের ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৪৯২ কপি বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে ৯ কোটি ১২ লাখ ১৬ হাজার ৬১০ কপি। সরবরাহের জন্য পোস্ট ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) হয়েছে ৯ কোটি ১ লাখ ৭৫ হাজার পাঠ্যবইয়ের।
বিতরণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিকে গত রোববার পর্যন্ত ২৭ কোটি ৯০ লাখ ৯০ হাজার কপি বই ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে সরবরাহের জন্য পিডিআই হয়েছে ২৪ কোটি ১৭ লাখ ৭২ হাজার বই। বাকি থাকা বইয়ের মধ্যে বেশিরভাগই নবম শ্রেণির বই। এই শ্রেণির বই শিক্ষার্থীরা দুই বছর পড়বে, যার কারণে এটিতে বাড়তি নজর দেওয়ায় সবার শেষে প্রিন্ট করা হচ্ছে। এ ছাড়াও যেসব বইয়ের পরীক্ষা হয় না; কিন্তু শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন হয়—এমন বইয়ের কাজ বাকি রয়েছে। এ ধরনের বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২-৩ কোটির মতো। সবমিলিয়ে আগামী ১০-১৫ মার্চের মধ্যে বই ছাপানোর কাজ শেষ হতে পারে।
এখনো জেলা পর্যায়ে অনেক শিক্ষার্থী বই পায়নি বলে জানা যাচ্ছে। ঝিনাইদহ জেলা শিক্ষা অফিস থেকে জানা গেছে, জেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ে চাহিদার ৩০ লাখ ৩৩ হাজার কপি বইয়ের মধ্যে ১ মার্চ পর্যন্ত পৌঁছেছে ২১ লাখ ২৬ হাজার বই। এখনো ৯ লাখের বেশি বই যায়নি শিক্ষার্থীদের হাতে। সবচেয়ে বেশি ঘাটতি অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই।
পাবনা সুজানগর উপজেলার খলিলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বাংলাদেশ শিক্ষক ফোরামের (বাশিফ) সভাপতি হাবিবুল্লাহ রাজু কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মাত্র দুটি করে বই গেছে। আর নবম ও দশম শ্রেণির আংশিক বই এসেছে।’
পাবনার আরেকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কালবেলাকে বলেন, বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুলবিমুখ। শিক্ষকদের বেশিরভাগই অনলাইন থেকে পিডিএফ নামিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানোয় উৎসাহী নন। ফলে ক্লাস হলেও গল্প করে কাটিয়ে দেন শিক্ষকরা।
তিনি বলেন, মে কিংবা জুনে স্কুলগুলোতে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা হবে, ঈদুল ফিতরের পরপরই হবে এসএসসি পরীক্ষা। বই দেরিতে পেলে শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের ঘাটতি শিক্ষার্থীরা কাটিয়ে উঠতে পারবে কি-না, সেটিও ভেবে দেখা দরকার। এ ছাড়া বই না পাওয়ায় অভিভাবকদের মধ্যেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পর্কে একটি বিরূপ ধারণা জন্ম দিচ্ছে। তাই সরকারকে এ বিষয়ে নজর দিতে হবে।
এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক আবু নাসের টুকু কালবেলাকে বলেন, মোট বইয়ের ৯৮ শতাংশের বেশি বিতরণের ছাড়পত্র পেয়েছে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির কিছু বই ছাপানো বাকি আছে। দ্রুতই শতভাগ বইয়ের কাজ শেষ হবে।
বিতরণ নিয়ন্ত্রক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘অষ্টম ও নবম শ্রেণির কিছু বই এবং ইবতেদায়ি পর্যায়ের কিছু বই ছাপা বাকি আছে। আশা করছি, দ্রুত সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাবে।’
সূত্র বলছে, কাগজ সংকট সামাল দিতে ৭ হাজার ৮০০ টন কাগজ ধাপে ধাপে চীন থেকে আসা শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে ছাপার কাজে গতি আসবে। তবে বাঁধাই শ্রমিকের কিছুটা সংকট রয়ে গেছে। নোট-গাইড ও অমর একুশে বইমেলার বই ছাপার কাজে ব্যস্ত ছিল শ্রমিকরা, যে কারণে বই ছাপার কাজে কিছুটা ধীরগতি দেখা দেয়। তবে মেলা শেষ হওয়ায় দ্রুতই সংকট কেটে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসানের মোবাইল ফোনে কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘কাগজের সংকট তেমন নেই। তবে বাঁধাই শ্রমিকের সংকট রয়েছে। সেজন্য আমরা নোট-গাইড কোম্পানিগুলোর সঙ্গে শ্রমিক ঠিক সময়ে পাওয়া নিয়ে সমঝোতায় এসেছি। সবকিছু ঠিক থাকলে ১০ মার্চের মধ্যে বই স্কুল পর্যায়ে চলে যাওয়া উচিত। এরপর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেবে।’
শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো নিয়ে এনসিটিবি আশার বাণী শোনালেও ভিন্ন বাস্তবতার কথা বলছেন ছাপাখানার মালিকরা। তারা বলছেন, বইয়ের সব কাজ শেষ করতে তাদের অন্তত মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ লেগে যাবে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি এবং পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান কালবেলাকে বলেন, বই যদি মার্চের মধ্যে ছাপা শেষ হয়ও, শিক্ষার্থীরা পাবে ঈদের পর। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামের দিকে শিক্ষকরাও ছুটিতে চলে গেছে।
মন্তব্য করুন