অবশেষে দ্বার খুলছে বহুল প্রত্যাশিত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের। আগামী ২ সেপ্টেম্বর এ প্রকল্পের প্রথম অংশের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত দূরপাল্লার যানবাহনকে রাজধানী ঢাকার এক প্রান্ত থেকে সরাসরি অন্য প্রান্তে চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। লক্ষ্য, শহরের ভেতরে সড়কে গাড়ির চাপ কমানো। সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক ৪৬ কিলোমিটারের এই প্রকল্পের পুরো কাজ শেষে হলে দিনে ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করতে পারবে। আগামী বছরের জুলাই মাসে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। গতকাল রোববার মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশের উদ্বোধন
উপলক্ষে শেরেবাংলা নগরে পুরোনো বাণিজ্য মেলা মাঠে সুধী সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে উপস্থিত থাকবেন।
নির্বাচন সামনে রেখে তড়িঘড়ি এসব প্রকল্পের উদ্বোধন করা হচ্ছে কি না, ‘ইলেকশনের সঙ্গে প্রকল্প উদ্বোধনের কোনো সম্পর্ক নেই। এলিভেটেড তেজগাঁও পর্যন্ত হচ্ছে, মানুষকে আমরা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রথম পর্বে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত উদ্বোধন হবে। এই অংশে মেইন লাইনের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে মোট ১৫টি র্যাম্পের মধ্যে ১৩টি উন্মুক্ত। গাড়ির গতিসীমা ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে। এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত আসতে সময় লাগবে ১০ মিনিট। এই উড়াল পথে পথচারী, বাইসাইকেল এমনকি আপাতত মোটরসাইকেলও চলাচলের সুযোগ পাবে না।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যানজট কমানোর পাশাপাশি যানবাহন চলাচলে গতি বাড়াবে। অবশ্য এটি পুরোপুরি চালু হলেই এর সুফলের বিষয়টি মূল্যায়ন করা যাবে। শুধু একটি অংশ চালু হলে কাকলী ও বিজয় সরণিতে যানজটের প্রবণতা বাড়তে পারে। তবে বিমানবন্দর থেকে ধানমন্ডি-লালমাটিয়াসহ আশপাশের এলাকার যাত্রীরা সংসদ ভবন এলাকায় চওড়া সড়কের কারণে অনেকটাই নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারবেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক কালবেলাকে বলেন, ২০১৩ সালে উদ্বোধনের লক্ষ্য নিয়ে প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রায় ১০ বছর পর অর্ধেক অংশের উদ্বোধন হচ্ছে। দীর্ঘ সময়ে নগরীতে মানুষ ও যানবাহন দুটোই বেড়েছে।
তিনি বলেন, ঢাকাকে বাইপাস করতে দূরপাল্লার যানবাহনের কথা চিন্তা করেই এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। যদি সুফলের কথা চিন্তা করি তাহলে পুরো প্রকল্প উদ্বোধন না হওয়া পর্যন্ত তা বলা যাবে না।
বিমানবন্দর থেকে টোল দিয়ে কাকলী নামার পর রাস্তা সরু হওয়ায় যানজট হবে উল্লেখ করে এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, কাকলীর যানজট দূর করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একটি প্রেসক্রিপশন দেওয়া হলেও তা মানা হয়নি।
উদ্বোধন শেষে উত্তরা থেকে ধানমন্ডিসহ আশপাশের এলাকার যাত্রীরা সুফল পাবেন। বিজয় সরণি মোড়ে র্যাংগস ওভারপাসে ট্রাফিক বেশি ও ভিআইপিদের যাতায়াত বেশি। তেমনি রাস্তার চাপা। এ কারণে কাকলী ও বিজয় সরণিতে যানজট বাড়বে বলেও মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) এ এইচ এম এস আকতার কালবেলা বলেন, ‘সুফলের চিন্তা থেকেই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। আশা করি, নগরবাসী যানজটের ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবেন। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ১০ মিনিট। এখন তো দীর্ঘ সময়ে এই পথটুকু পাড়ি দিতে হচ্ছে।’
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারে চার ক্যাটাগরিতে টোল আদায় করা হবে। ক্যাটাগরি-১ এ কার, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) এবং হালকা ট্রাক (৩ টনের কম) ৮০ টাকা, ক্যাটাগরি-২ এ মাঝারি ট্রাক (৬ চাকা পর্যন্ত) ৩২০ টাকা, ক্যাটাগরি-৩ এ ট্রাক (৬ চাকার বেশি) ৪০০ টাকা, ক্যাটাগরি-৪ এ সব ধরনের বাস (১৬ সিট বা তার বেশি) ১৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের নথি বলছে, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় এ পর্যন্ত যত অবকাঠামো প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সবচেয়ে বড়। এক্সপ্রেসওয়ের মোট ব্যয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এর মূল অংশের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। সেইসঙ্গে মূল উড়াল সড়কে ওঠানামার জন্য ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র্যাম্প থাকবে। এই র্যাম্পসহ মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। গত জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম অংশের ভৌত অগ্রগতি ৯৭ দশমিক ৭৫ ভাগ। দ্বিতীয় অংশের ৫৮. ১০ ভাগ।
প্রকল্পের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সংশোধিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পটি হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে শুরু হয়ে কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-মালিবাগ-খিলগাঁও-কমলাপুর হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (কুতুবখালী) পর্যন্ত যাবে।
প্রকল্পটি থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইটালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড (৫১ শতাংশ) এবং চায়নাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ (৩৪ শতাংশ) ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডের (১৫ শতাংশ) যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে।
মন্তব্য করুন