প্রজাপতি পরিবহন চলাচল করে আব্দুল্লাহপুর থেকে বছিলা। বসুমতী পরিবহন গাবতলী থেকে আব্দুল্লাহপুর। এই রুটের পরিবহনগুলোর কালশী থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত পজ মেশিনে ভাড়া ছিল ১০ টাকা; কিন্তু হঠাৎ করেই সম্প্রতি এসব বাসের স্টাফরা তাদের ইচ্ছামতো ১০ টাকার স্থলে আদায় করছেন ১৫ টাকা। আবার খিলক্ষেত থেকে বাড্ডা হয়ে কাকরাইলের ভাড়া ২৫ টাকার স্থলে নেওয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। খিলক্ষেত থেকে বনানীর ভাড়া ১০ টাকার স্থলে ১৫ টাকা। ওয়েবিলের দোহাই দিয়ে এমনটি করা হচ্ছে, যদিও এই ওয়েবিল নিষিদ্ধ করা হয়েছে তিন বছর আগেই।
কথা হয় শাহাদাৎ হোসেন নামে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে। ব্যবসার কারণে নিয়মিত তাকে খিলক্ষেত-মিরপুর রুটে যাতায়াত করতে হয়। প্রজাপতি পরিবহনে খিলক্ষেত থেকে মিরপুর ১০ নম্বর যাওয়ার পথে ভাড়া আদায়কারী তার কাছে ২০ টাকা দাবি করলে তিনি ই-টিকিট চান। তিনি জানতে চান, ‘পজ মেশিনে ই-টিকিটে একই পথের ভাড়া ছিল ১০ টাকা। এখন ২০ টাকা কেন?’ তখন পরিবহন শ্রমিকের সাফ জবাব, ‘মেশিন নেই, মালিক নিয়ে গেছে। আপনাকে এত জবাব দিতে পারব না, যাত্রীর অভাব নেই। না পোষালে নেমে যান।’ এরপর শাহাদাৎ বাধ্য হয়েই ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে দেন।
সংসদ ভবন থেকে মগবাজার পর্যন্ত লাভলী পরিবহনে ভাড়া আদায় করা হয় ২০ টাকা। চার কিলোমিটার পথও হবে না—এমন দূরত্বে এক যাত্রীর কাছ থেকে ২০ টাকা ভাড়া চাইলে তিনি এর কারণ জানতে চান। এ নিয়ে যাত্রীর সঙ্গে ভাড়ায় আদায়কারীর বাগবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায় গাড়িটির চালক বলেন, ‘ওয়েবিল অনুসারে ভাড়া নেওয়ার নির্দেশ আছে মালিকের। তারা রেট কইরা ভাড়া মিলায়ে দিছে। উনারা (মালিক) যে ভাড়া নিতে বলেছে, আমরা সেই ভাড়াই নিতাছি।’
ঢাকা মহানগরীর বাসগুলোতে বাড়তি ভাড়া আদায়ে নানা সমালোচনার পর ২০২২ সালের ১০ আগস্ট বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) তৎকালীন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে বৈঠক করে ওয়েবিল প্রথা সম্পূর্ণ বাতিল করে দেয়। চালু করে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের (পজ মেশিনে) মাধ্যমে দূরত্ব অনুপাতে ভাড়া আদায় পদ্ধতি। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরই সেই ই-টিকিটিং পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে পরিবহন শ্রমিকরা ফের ওয়েবিল প্রথায় যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় শুরু করেন। অর্থাৎ যাত্রী যে স্টপেজেই নামুক না কেন, তাকে পরবর্তী কথিত ওয়েবিল চেকআপ পর্যন্ত ভাড়া গুনতে হবে।
ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম বলেন, ‘১৬ বছর ধরে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঢাকা শহরে বাস-মিনিবাস চুক্তিতে যাত্রী পরিবহন করেছে। এতে রুটে গাড়ি চলাচলে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে। যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করার কারণে যানজট ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং দুর্ঘটনা ঘটছে।’ বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে শুধু চালক-মালিক নন, যাত্রীদেরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন রুট ঘুরে দেখা যায়, কোনো বাসেই ভাড়ার তালিকা নেই। এমনকি গত ৬ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধনকৃত কাউন্টার ও ই-টিকিটিং পদ্ধতিও তেমন নজরে আসেনি। বাসগুলোতে আগের মতো ওয়েবিল পদ্ধতিতেই যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে।
এ প্রসঙ্গে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ঢাকা মহানগরীতে চলাচলকারী বাসগুলো যাত্রীদের থেকে প্রতিদিন ১ কোটি ৮২ লাখ ৪২ হাজার টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় করে নিচ্ছে। গণপরিবহনে নগদ টাকার লেনদেন বন্ধ না হলে ভাড়া নৈরাজ্য থামানো অসম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি ও ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ করতে হলে প্রতিটি বাসকে কাউন্টারভিত্তিক ও ই-টিকিটিংয়ের আওতায় নিতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি ওয়েবিল পয়েন্টে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাতে হবে। এসব বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথোপযুক্ত আইন প্রয়োগের ব্যাপারে আরও কঠোর হতে হবে।’
এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) মীর আহমেদ তারিকুল ওমর বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে আমরা নিয়মিতভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। পাশাপাশি জরিমানা করে গণপরিবহন খাতকে নিয়মমাফিক চলাচলে চেষ্টা কেরা হচ্ছে।’
ওয়েবিলের সাফাই গেয়ে বিকাশ পরিবহন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসএম সৌরভ বলেন, ওয়েবিল প্রথা নিয়ে এখন নানা সমস্যার পাশাপাশি পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি হয়েছে। সত্যি কথা বলতে আমরা ওয়েবিল ছাড়া গাড়িতে চলাচলকৃত যাত্রীদের প্রকৃত হিসাব ও ন্যায্য প্রাপ্তিটা পাচ্ছি না। গাড়ির মালিক ও চালকদের উভয়পক্ষের সুবিধার জন্যই ওয়েবিল প্রথা চালু রাখা হয়েছে।’
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘পজ মেশিন সঙ্গে রাখা এবং এটা দিয়ে ভাড়া আদায় একটি ঝামেলা মনে করেন শ্রমিকরা। তারা এই মেশিনকে হয়রানি মনে করছে; তাই মেশিন ব্যবহার না করে মালিকদের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করছে।’