গোলাম ফারুক, পাবনা
প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:২২ এএম
আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আশ্রয়ণের মানুষগুলো এখন বাঁধে

ফের গৃহহীন
আশ্রয়ণের মানুষগুলো এখন বাঁধে

প্রথমে ছিলেন তারা গৃহহীন। থাকতেন যেখানে-সেখানে। পথে-প্রান্তরে কেটেছে সময় দিন বছর। একটা সময় ঠাঁই হয় সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে। ভেবেছিলেন কিছুই না থাক, এই সরকারি রঙিন আবাসে কেটে যাবে বাকি জীবন। দু মুঠো আনতে পারলে বাঁচবে প্রাণ। তবে তাদের পথচলা সে স্বপ্নরেখায় মেলেনি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাদের সেই ঘরগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে একটি প্রভাবশালী চক্র। ওই জমি নিজেদের দাবি করে দখল-উচ্ছেদে তাদের করা হয়েছে গৃহহীন। ফের আকাশকে ছাদ করে তারা আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধে।

এমনই ঘটনা ঘটেছে পাবনা সদরের ভাড়ারা পশ্চিম জামুয়া গুচ্ছগ্রামে। গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ওই সন্ধ্যা ও রাতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬০টি ঘর গুঁড়িয়ে দিয়ে জমি দখল করেছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। এতে ঘরহারা হয়েছেন সেখানে বসবাস করা মানুষ।

তাদের কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছেন পার্শ্ববর্তী বাঁধে। তাদের একজন হলেন ফুলমালা বেগম। সেখানে তিনি টিন আর পাটকাঠি দিয়ে ঝুপড়ি ঘর তুলেছেন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘শেখ হাসিনা পালায়ে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় কিছু লোক এসে আমাগারে এক ঘণ্টার মধ্যি ঘর ছাইড়ে দিয়ার জন্যি নির্দেশ দেয়। তখন রান্না করতেছিলাম। তাগারে অনুরোধ কইরেও কাম হয় নাই। সারারাত না খায়ে ঘরের বাইরে বসে কাঁদিছিলাম। সকালে কাপড় চোপড় লিয়ে বাপের বাড়িতে যাই। সেহেন থেনে এই বাঁধে আইসে কোনো রহমে এই ঘরডা তুইলে আছি। আমরা সরকারের কাছে মাথা গুজার ঠাঁই চাই।’

আশ্রয়ণের ঘর হারানো আরেকজন হলেন বাচ্চু প্রামাণিকের স্ত্রী ফাতেমা খাতুন (৭০)। সেদিনের বর্ণনা দিয়ে কেঁদে কেঁদে তিনি বলেন, ‘ওইদিন পরথম কয়েকজন আইছিল।

ঘণ্টাখানেক পর পিরায় ৩/৪শ লোক আইসে আমাগারে উপর সেই হম্বিতম্বি। এক ঘণ্টা সুময় দিয়ে কইলো যার যা আছে টুপলা বাঁইধে চইলি যা। না হলি বিপদ হবি। এই কয়া ভাঙচুর শুরু করে। পরে কী করবো, দিশা মিশা না পায়া যা ছিল কাপড় চোপড় একটা ছাগল ছিল লিয়ে চইলে আসি। পরে সেই ছাগলডা বেইচে এই বাঁধে কুনুরহম ঘরডা তুইলে আছি।’

ওই বৃদ্ধার ছেলে আলম শেখ বলেন, ‘ভাঙচুর শুরু হলি আমার বৃদ্ধা মাকে নিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছিলাম। কোনো যাবো কী করব দিশেহারা অবস্থা তখন। পরে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় লেই। আর দিনমজুরি কইরে বাঁধের এহেনে আইসে ছাপরা তুইলে মাকে লিয়ে আছি।’

ওই ঘটনায় শুধু ঘর ভাঙচুরই নয়, লুট করা হয়েছে ঘরের দরজা, জানালা, টিনের চালসহ প্রায় সবকিছু। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় জামায়াত-বিএনপি সমর্থক কিছু লোক ঘর স্থাপন করা ওই জমি নিজেদের দাবি করে পরিবারগুলোকে জোরপূর্বক তুলে দিয়েছে। তবে জমির স্বপক্ষে কোনো দলিল বা কাগজপত্র দেখাতে পারেননি তারা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ওই ঘটনার পর প্রশাসনকে বারবার জানানো হলেও এই পাঁচ মাসেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

ঘটনার পর প্রশাসনকে বারবার জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন ভাঁড়ারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ খান। তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগীরা এখন বাঁধের ওপর মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের টয়লেট, পানির ব্যবস্থা নেই। দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন তারা। সরকারের সঙ্গে দখলদারদের জমি নিয়ে ঝামেলা থাকুক সমস্যা নেই। কিন্তু এই গরিব মানুষগুলোর তো কোনো দোষ নাই। তারা কোথায় যাবে এখন। তাদের দ্রুত পুনর্বাসনের দাবি জানাই।’

ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের জমি নিজেদের দাবি করে আদালতে মামলা চলমান উল্লেখ করে সেখানে সাতজনের নামসংবলিত একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে ওই চক্র। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আদালতে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় জোরপূর্বক তাদের জমি দখল করে সেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করা হয়।

গত সোমবার সরেজমিন দেখা যায়, সেখানে যেন টর্নেডো বয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে প্রকল্পটি। সুনসান নীরবতা। কেউ নেই। প্রকল্পের ৬০টি ঘরের সবই ভাঙাচোরা। দরজা, জানালা, টিন, ইটের দেয়াল কোনোকিছু অবশিষ্ট নেই। ভেঙে ফেলা ইট-সুরকি চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কোনো ঘর সবটুকুই ভাঙা, কোনোটি অর্ধেক। ভেঙে ফেলা ঘরে লোহার রড বেরিয়ে রয়েছে। প্রায় প্রতিটি ঘরের সামনে ও আশপাশে শাকসবজি আবাদ রয়েছে।

জানা গেছে, দেশব্যাপী ভূমিহীনদের জমিসহ ঘর দেওয়ার উদ্যোগ নেয় পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। এরই অংশ হিসেবে ২০২০ সালে পশ্চিম জামুয়া গ্রামে ভূমিহীন ৬০টি পরিবারকে দলিলসহ ঘর বুঝিয়ে দেয় স্থানীয় প্রশাসন।

এরপর গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী সরকারের পতনের পর ওইদিনই সন্ধ্যায় ও রাতে সেই জমি নিজেদের দাবি করে বসবাস করা ভূমিহীন পরিবারগুলোকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেয় ওই চক্র। আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাদের অস্ত্রের মুখে ঘর ছাড়তে বাধ্য করে তারা। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় আশ্রয়ণ প্রকল্পের সব ঘর। স্থানীয়রা জানান, সেখানে ৬০টি ঘর থাকলেও, বসবাস করতেন ৪০টি পরিবার।

ওই জমির মালিক দাবিদার সাতজন হলেন ভাড়ারা পশ্চিম জামুয়া গ্রামের আকরাম প্রামাণিক, উম্মত প্রামাণিক, আক্কাস প্রামাণিক, ইব্রাহিম প্রামাণিক, ইসমাইল প্রামাণিক, নায়েব আলী ও নবাব আলী। তাদের বেশিরভাগই জামায়াত ও দু-একজন বিএনপি সমর্থক বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশিত হলে নজরে আসে সবার।

সেখানে প্রবেশমুখেই ঝোলানো সাইনবোর্ডে লেখা—নিম্নবর্ণিত সম্পত্তি লইয়া পাবনা সদর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা চলমান। বাদী সাতজনের নাম, বিবাদী সরকার। জমির পরিমাণ ১ দশমিক ৩৮ একর।

সাংবাদিক আসার খবরে সেখানে আসেন জমির মালিক দাবিদার নায়েব আলী ও আক্কাস প্রামাণিকের ছেলে আতিক। তারা বলেন, ‘এই জমি আমাদের। কিন্তু পতিত সরকারের সন্ত্রাসী আবু সাইদ খান তার বাহিনী দিয়ে এই জমি জোর করে দখল নিয়ে প্রশাসনকে দিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প করেছিলেন।’

তারা আরও বলেন, ‘এই জমি নিয়ে ২০১০ ও ২০২০ সালে আদালতে মামলাও করেছি আমরা। সেই মামলা চলমান অবস্থায় প্রশাসনের লোকজন নিজেদের ইচ্ছামতো আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর করেছে। আমরা অসহায় ছিলাম, কিছু করতে পারিনি। আমাদের জমি দাবি করে তাদের চলে যেতে বলেছিলাম, তবে ঘর ভাঙচুরের সঙ্গে আমরা জড়িত না। তারা নিজেরাই ঘরের সবকিছু ভেঙে নিয়ে চলে গেছে। এখন আমাদের ওপর মিথ্যা দোষারোপ করা হচ্ছে।’

এ বিষয়ে পাবনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাড়িগুলো ভেঙে ফেলার বিষয়টি প্রথমে জানা ছিল না। তবে নজরে আসার পর আমি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে বলেছি। পুরো বিষয়টি জানার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যদি কেউ ভেঙে থাকে, তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জমি নিয়ে মামলা আছে কি না জানা নেই উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘কাগজপত্র না দেখে বিষয়টি নিয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়।’

পাবনা সদর উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রতিটি ঘর নির্মাণে খরচ হয় ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। সে হিসেবে ৬০টি ঘর নির্মাণে সরকারের খরচ হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আগামী বছরের ইজতেমার তারিখ ঘোষণা

বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পেতে সতর্কতামূলক পরামর্শ

আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদ ডিইউএমসিজেএএ’র

৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবি

তিলকারত্নের বিদায়: নারী দলের কোচ খুঁজছে বিসিবি

রূপগঞ্জে ছুরিকাঘাতে আহত ২ কিশোরের মৃত্যু

টেন্ডার ছাড়াই ৭০ হাজার টাকায় ১৮ বিঘা জমি নিলেন বিএনপি নেতা

সরকারি চাকরির স্বেচ্ছায় অবসরের বয়স-পেনশন নিয়ে যেসব প্রস্তাব

হাজিদের মোটা অঙ্কের অর্থ ফেরত দিচ্ছে এশিয়ার মুসলিম দেশ

‘বিএনপি ও প্রশাসনের কতিপয় লোকজন আ.লীগকে রক্ষা করছে’

১০

ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে নির্বাচন যেন বিলম্বিত না হয় : সাইয়েদুল আলম

১১

বিইউ’র নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম

১২

কামরুলের ১৫ হিসাবে সাড়ে ৩ কোটি টাকা অবরুদ্ধ

১৩

দেশকে খুনি হাসিনা ধ্বংস করে গেছে : ড. খন্দকার মারুফ

১৪

রংপুর শহরে বন্ধ সব পেট্রল পাম্প, ভোগান্তি চরমে

১৫

কমেছে বিদেশগামী অভিবাসীর সংখ্যা, বেড়েছে নারীদের বিএমইটি নিবন্ধন  

১৬

পুলিশের গাড়ি থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সেই আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার 

১৭

বাংলাদেশকে চার প্রদেশে ভাগ করার সুপারিশ

১৮

৫০ হাজার টন গম এলো আর্জেন্টিনা থেকে

১৯

শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় খালাস পেলেন যারা

২০
X