বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্যাসের বকেয়া বিল চেয়েছে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন ও দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি সরবরাহকারী কোম্পানি কাতার গ্যাস। এ দুই কোম্পানির বকেয়া বিলের পরিমাণ ৩৭ কোটি ডলার। গত বৃহস্পতিবার জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিবকে তারা চিঠি পাঠায়। চিঠিতে টাকা পরিশোধ করতে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। চিঠির অনুলিপি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকেও দেওয়া হয়েছে। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এর আগে চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ও এইচটিজির পক্ষে চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশকে বিদ্যুতের বকেয়া বিল পরিশোধের তাগাদা দিয়েছিল। তার আগে বিশেষ চাপ দিয়েছিল ভারতের আদানি গ্রুপ।
গত বৃহস্পতিবার শেভরনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও প্রেসিডেন্ট এরিক এম ওয়াকার স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, গ্যাস বিক্রি বাবদ পেট্রোবাংলার কাছে শেভরনের পাওনা ২২ কোটি ডলার। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের দায়িত্বে রয়েছে মার্কিন এই কোম্পানিটি। এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে দেশে চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ গ্যাস সরবরাহ করে শেভরন। এ ছাড়া মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রেও কাজ করছে কোম্পানিটি। একক কোম্পানি হিসেবে শেভরন দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের ৬০ শতাংশ এবং দেশীয় কনডেনসেটের ৮৩ শতাংশ উৎপাদন করে।
শেভরনের চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত এড়াতে সরকারকে অন্তত ৭ দশমিক ৫ কোটি ডলার এখন ছাড় করার জন্য বলা হয়েছে। গ্যাস এবং কনডেনসেট সরবরাহের জন্য শেভরনের মাসিক বিল প্রায় ৪ কোটি ডলার। বিবিয়ানার ২৬টি কূপ দিয়ে সর্বোচ্চ এক দিনে ১২শ মিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলনের রেকর্ড থাকলেও গতকাল উৎপাদন হয়েছে ৯৭৭ মিলিয়ন ঘনফুট।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, কোম্পানিটির সরবরাহ করা কয়েক মাসের গ্যাসের বিল বকেয়া পড়েছে। গত ডিসেম্বরে শেভরন ইন্টারন্যাশনাল এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক ক্যাসুলো বাংলাদেশ সফর করেন। ওই সফরে ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই বৈঠকেও বকেয়ার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে বলেও তিনি জানান।
অন্যদিকে, জিটুজি (সরকারি পর্যায়ে) ভিত্তিতে কাতার থেকে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি আমদানি করছে বাংলাদেশ। সরবরাহ করা এলএনজির বিপরীতে কাতার গ্যাস ১৫ কোটি ডলারের বকেয়া বিল পরিশোধ করতে বলেছে। জিটুজি ভিত্তিতে কাতার থেকে বছরে ৪০ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়।
দেশের চাহিদা মেটাতে ২০১৮ সালে এলএনজি আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। ওই সময় কাতার ও ওমানের সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদি দুটি পৃথক চুক্তি করা হয়। ওই চুক্তির আওতায় এখন পর্যন্ত দেশ দুটি থেকে সরকারি পর্যায়ে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে এলএনজি মূল্য। উচ্চমূল্যের পাশাপাশি টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দামও বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়ে পেট্রোবাংলা। দফায় দফায় দাম বাড়িয়েও সামাল দিতে পারছে না।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, দেশীয় উৎস থেকে পাওয়া গ্যাসের গড় দর পড়ছে ৬ টাকা ৭ পয়সার মতো। এর সঙ্গে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করার পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে গড় মূল্য দাঁড়ায় ১৯ টাকা ৯ পয়সা। আর তখন গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ১১ টাকা ৯১ পয়সা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানির পর গড় মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৩ টাকা ৮৫ পয়সা। ওই বছর গড় বিক্রয় মূল্য ছিল ২২ টাকা ৮৭ পয়সা। ঘনমিটার প্রতি লোকসান হয়েছে ৯৮ পয়সা করে। গত ছয় অর্থবছরে ঘাটতি হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র আরও জানায়, পেট্রোবাংলার কাছে যেমন অর্থ পাওনা রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের, তেমনি পাওয়ার সেক্টরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে পেট্রোবাংলার বকেয়ার পরিমাণ ২৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গতকাল শুক্রবার জ্বালানি ও খনিজসম্পদ সচিব ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।