নরসিংদী জেলার বিভিন্ন চরাঞ্চল, বিশেষ করে রায়পুরা উপজেলায় ‘চুন থেকে পান খসলেই’ একপক্ষের সঙ্গে অন্যপক্ষের টেঁটাযুদ্ধ লেগে যেত। টেঁটা-বল্লমের ব্যবহার আগের মতোই আছে, এবার তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। রায়পুরার দুর্নাম ‘ঘুচিয়ে’ পুরো নরসিংদী জেলায় এখন অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। এসব অস্ত্র আর অস্ত্রবাজদের দাপটে দিন দিন অশান্ত হয়ে ওঠছে কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ এই জেলা। শুধু শহর নয়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার অবাধে হচ্ছে। গত কয়েক মাসে নজিরবিহীন কিছু সংঘর্ষ-হামলার ঘটনায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন।
নরসিংদীর ৬টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয় রায়পুরা উপজেলায়। বিশেষ করে দুর্গম চরাঞ্চলে। গত ৫ মাসে সংঘর্ষের ঘটনা কেন্দ্র করে সব চেয়ে বেশি খুন হয়েছে রায়পুরাতেই।
ঘটনা অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তাদের বেশিরভাগ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। গত বছরের ১৩ আগস্ট দিনে-দুপুরে রায়পুরা উপজেলার শ্রীরামপুর রেলগেট এলাকায় মনিরুজ্জামান মনির নামে এক সাংবাদিককে প্রকাশ্যে গুলি করা হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর বর্তমানে তিনি কিছুটা সুস্থ। এ ঘটনার এক মাস পরই ২৩ অক্টোবর একই উপজেলার শ্রীনগর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে দুপক্ষের সংঘর্ষে ৬ জন নিহত হন। নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। ওই ঘটনায় অন্তত ১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
এ ছাড়া গত ৬ নভেম্বর সকালে রায়পুরা উপজেলার মির্জাচর ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামের মেঘনা নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলনের সময় ড্রেজার আটক করে গ্রামবাসী। আটককৃত ড্রেজার ছিনিয়ে নিতে গ্রামবাসীর ওপর গুলিবর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। গত ৭ ডিসেম্বর একই উপজেলা মেথিকান্দা এলাকায় দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্যসহ দুজন নিহত ও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১০ জন। এরপর গত ১১ ডিসেম্বর একই উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল বাঁশগাড়ী এলাকায় দুপক্ষের সংঘর্ষে বাড়িঘরে আগুন ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় উভয়পক্ষের গুলিবিদ্ধসহ ১০ জন আহত হয়েছেন। সংঘর্ষে দুপক্ষই আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করেছে।
এ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শুধু যে রায়পুরার চরাঞ্চলেই হচ্ছে, তা নয়। নরসিংদী সদর উপজেলায়ও এ পর্যন্ত যতগুলো সংঘর্ষ, হামলা, মারামারি হয়েছে, সবগুলোয় আগ্নেয়াস্ত্রেরই ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৬ নভেম্বর মাধবদী থানার মহিষাশুড়া ইউনিয়নের বালুসাইর গ্রামে জুট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধসহ তিনজন আহত হয়েছেন। এরপর গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গুলি করে একজনকে হত্যা করা হয়েছে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও তিনজন। ২১ ডিসেম্বর রাতে সদর উপজেলার পাঁচদোনা বাজার এলাকায় ডেকে নিয়ে একজনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত ৯ নভেম্বর দুপুরে পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের গালিমপুর গ্রামে দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হন উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক বাদল মিয়া।
এ রকম আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নরসিংদীর অন্য উপজেলাতেও প্রায়ই ঘটছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কিংবা আধিপত্য, যে কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাতে অবাধে ব্যবহার হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। এসব অস্ত্র ব্যবহার করার সময় দেখা যায় অধিকাংশরাই মাথায় হেলমেট। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অস্ত্র হাতে হেলমেট বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে।
আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের পাশাপাশি পুলিশের ওপর হামলা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন জেলার সাধারণ মানুষ। এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রায়ই অভিযান চালিয়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও আটক করছে অস্ত্রধারীদের। এর হোতাদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তার পরও অবৈধ অস্ত্রধারীদের দৌরাত্ম্য থামছে না।
জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ মাসে জেলার ৭টি থানায় মোট ৬৪৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে খুনের ঘটনায় ৫৯টি মামলা করা হয়। এ ছাড়া অস্ত্র মামলা ১০টি, ডাকাতির মামলা ৭টি, চুরির মামলা ৪৯টি এবং বিভিন্ন অপরাধে আরও ৫২১টি মামলা হয়েছে।
জেলা পুলিশ সুপার মো. আব্দুল হান্নান বলেন, এসব ঘটনায় মামলা হচ্ছে। মামলার রেফারেন্সে আসামি ধরা হচ্ছে। এ ছাড়া অস্ত্র উদ্ধারেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমানে জেলার আইনশৃঙ্খলা ভালো।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নরসিংদী জেলার শাখার সাধারণ সম্পাদক হলধর দাস বলেন, সমাজ ব্যবস্থার আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীরা যেন তাদের ধরনও পাল্টে দিয়েছে। পুলিশ যতটা নীরব ততটা সরব সন্ত্রাসীরা। এখন অপরাধ সংঘটনের আগে অপরাধীরা আধুনিক কৌশল ও প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে থাকে। মনে হয় যেন, তারা পুলিশ বাহিনীর চাইতেও বড় কোনো বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর শক্তিমত্তা, কৌশল ও ব্যবস্থাপনার প্রতি দৃষ্টি রেখেই তারা তাদের পরিকল্পনার ছক আঁকে। মনে হয় যেন, তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সোর্স আছে। পুলিশ জানার আগেই তারা অপরাধ সংঘটিত করে দ্রুত গা-ঢাকা দেয়। যার ফলে অপরাধীরা দিন দিন শক্তিশালী হয়ে ওঠছে। বেড়েছে খুন, ছিনতাই, রাহাজানিসহ বিভিন্ন অপরাধ। এসব থেকে অবসান পেতে হলে আগে সন্ত্রাসীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। বিচারকার্য দ্রুত সম্পন্ন করে অপরাধীদের সাজা দেওয়ার চিত্র সমাজে তুলে ধরতে পারলে অপরাধীরা পিছপা হবে।