নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে দুবার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল বাংলাদেশ। দুই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলই দেশের বাইরে। এর একটি তীব্র আরেকটি মাঝারি মাত্রার। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভূমিকম্পের আঘাত উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। প্রতিবার বড় কোনো ভূমিকম্প হলে সপ্তাহখানেক চলে ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা। ঝুঁকি কমাতে নানা উদ্যোগ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও তা কার্যকর হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূ-অভ্যন্তরে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। বারবার এসব কম্পন দিচ্ছে বড় ভূমিকম্পের বার্তা। ৫ মাত্রার ওপরের ভূমিকম্প দেশের জন্য আশঙ্কার। বিপদ আসতে পারে যে কোনো সময়। বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকায় সচেতনতা ও প্রস্তুতিকেই সর্বোচ্চ করণীয় বলে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত চীনের প্রত্যন্ত তিব্বত অঞ্চল। শতাধিক মানুষের প্রাণহানিতে শোকাহত গোটা বিশ্ব। প্রকৃতির রুদ্ররূপের সামনে মানুষের অসহায়ত্ব ফুটে উঠল আরও একবার। গতকাল মঙ্গলবার সাতসকালে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে টানা কয়েক সেকেন্ড ধরে কয়েক দফা দুলুনিতে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশে এ ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গলবার সকাল ৭টা ৫ মিনিট ১৬ সেকেন্ডে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এর উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে ৬১৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে চীনের একটি স্থান। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ১, যা তীব্র ভূমিকম্প। এর প্রভাবে রাজধানীসহ দেশের কিছু এলাকায় কম্পন অনুভূত হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর বলেন, এত দূরে উৎপত্তি হওয়া দুটি ভূমিকম্পের তেমন কোনো প্রভাব আমাদের এখানে নেই। কম্পন অনুভূত হলেও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। যে দুটি ভূমিকম্প গত সাত দিনের মধ্যে হয়ে গেল, সেগুলোর উৎপত্তিস্থলগুলোর বিবেচনায় বলা যায়, ওইসব এলাকা এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ। ওইসব এলাকায় মাঝেমধ্যে এ ধরনের ভূমিকম্প হয়। হিমালয়ের এভারেস্টের উত্তর প্রান্তে আজকের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। হিমালয় পরিবেষ্টিত ওই এলাকায় আগেও এমন ভূমিকম্প হয়েছে।
গতকালের ভূমিকম্পের বিষয়ে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ জানিয়েছেন, ভূমিকম্পটি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে সংঘটিত হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের খুবই কাছে এই শক্তিশালী ভূমিকম্পটি সংঘটিত হয়েছে; তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে রংপুর বিভাগের জেলাগুলোয় এই ভূমিকম্পটির কারণে বেশ ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে। ২০১৫ সালের পর এই ভূমিকম্পটি সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় একাধিক আফটার শক ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে, যা বাংলাদেশ থেকেও অনুভূত হতে পারে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় কাঁচা-পাকা মিলিয়ে ২১ লাখ ৪৬ হাজার ৬২৬টি ভবন আছে। এগুলোর মধ্যে ৫ লাখ ১৩ হাজার ৫০৭টি পাকা বা কংক্রিটের ভবন। আধাপাকা ভবন আছে ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৬২০টি। টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হলে রাজধানীতে কমপক্ষে ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৬১৯ ভবন ধসে পড়তে পারে। প্রাণ হারাতে পারে ২ লাখ মানুষ। অন্যদিকে সিলেটের ফল্ট লাইনে ৭ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫ ভবন ধসে পড়তে পারে। ১৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
এ যাবৎকালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প আঘাত হানে ১৮৯৭ সালে। ৮ দশমিক ৩ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক নামে পরিচিত এ ভূমিকম্পে মারা যায় প্রায় দেড় হাজার মানুষ।
ভূমিকম্পে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের তালিকায় ঢাকা অন্যতম। এক জরিপে দেখা গেছে, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পল্লবী, রামপুরা, মতিঝিল ও খিলগাঁওয়ের মতো এলাকার অনেক স্থাপনা কাঠামোগত ও নকশার মান পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের জৈন্তাপুর চরম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় একটি উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ঢাকায় অকল্পনীয় মাত্রার বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই বলে আসছেন, ঢাকা মহানগর ভূমিকম্পের কারণে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দুটি বিপজ্জনক চ্যুতিরেখার (ইন্ডিয়ান ও বার্মা) সংযোগস্থলে বাংলাদেশ অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানে বড় ভূকম্পনের ঝুঁকি থাকে। একটি ঢাকা মহানগরের সবচেয়ে কাছে টাঙ্গাইলের মধুপুর চ্যুতিরেখা, অন্যটি সিলেট অঞ্চলের ডাউকি চ্যুতিরেখা। এ ছাড়া নদনদীর গতি পরিবর্তন হওয়ায় তা দেশে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ সৈয়দ হুমায়ুন আখতার কালবেলাকে বলেন, ছোট ছোট ভূমিকম্প মূলত বড় শক্তি নিয়ে ভূমিকম্প হওয়ার প্রাথমিক ধাপ। এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে। আর বড় কোনো কিছু হলে আগে ছোট কিছু বিষয় ধরা পড়ে। বাংলাদেশ তিনটি (টেকটনিক) প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এসব অংশে শক্তি জমা আছে, সেটা যদি একসঙ্গে বের হয়, তাহলে ৮ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ বলেন, ঢাকাসহ শহরগুলো যেভাবে অপরিকল্পিত, অনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়ে উঠেছে, তাতে জনসংখ্যার যে ঘনত্ব, বড় ভূমিকম্প হলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি অনুমেয়। এখন যদি আমরা প্রস্তুতি নিই এবং জনগণকে দুর্যোগ মোকাবিলায় মহড়ার মাধ্যমে সচেতন করতে পারি, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। তবে দুই দশক ধরে এত তাগিদ দেওয়ার পরও সেভাবে মহড়া হয় না। পাশাপাশি কিশোর ও তরুণদের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদে এ নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে অ্যাপভিত্তিক গেইমের মতো ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে।
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, আতঙ্ক না ছড়িয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আতঙ্কে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বাড়ে। এখন দরকার মহড়া। ঢাকা শহর বা নগরগুলোয় ওয়ার্ডভিত্তিক নিয়মিত মহড়ার আয়োজন করতে হবে। প্রতি বছরে একবার করলেও হবে। ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে পালাক্রমে বছরের যে কোনো সময় সচেতনতামূলক মহড়া করতেই হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ১২৫ থেকে ১৭৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। সেই হিসাবে বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প হওয়ার সময় এসেছে। প্রতি মাসেই কয়েকটি মৃদু আকারের ভূমিকম্প হচ্ছে। ১৮৬৯ সালে সিলেটের কাছার এলাকায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ও ১৯২৩ সালে দুর্গাপুরেও বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ফলে সেখানে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়, যা সুপ্ত অবস্থায় আছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প সেটিকে নাড়াচাড়া দিতে পারে। তাই এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।
তিনি বলেন, ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কাজ যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য দমকল বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং আধুনিক উদ্ধার সরঞ্জাম মজুত রাখতে হবে। তবে বড় ধরনের ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি অধিক ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ বিধায় আমাদের যথাযথ নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণের দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে।